বিনা পুঁজিতে নিশ্চিৎ আয় চুক্তিভিত্তিক পোলট্রি খামার

326

বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় মুরগির সরবরাহ বাড়াতে নতুন পদ্ধতি ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক পোলট্রি খামার।’ বিনা পুঁজিতে এই পদ্ধতিতে নিশ্চিৎ লাভের এ ব্যবসা মুরগির খামারিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ক্রমবিকাশমান এ খাতে ভিনদেশীদের আগ্রাসন ছাপিয়ে সেবা আর লাভে খামারিদের আস্থার শিখরে উঠে এসেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান।

রাষ্ট্রীয় প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বলছে, করোনার আগে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মুরগির খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজার। পরবর্তীকালে খাবার ও ওষুধের চড়া দাম, উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে মুরগি বিক্রি, রোগ বালাইয়ে খামারে মড়ক লাগাসহ হরেক কারণে ব্যক্তি পর্যায়ের অধিকাংশ খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কিছু সংখ্যক খামারি দেশী-বিদেশী কোম্পানীর সাথে চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনা (কেজি প্রতি উৎপাদন ফী) করছেন বলেও সংস্থাটির মাঠ পর্যায়ের তথ্য স্মারণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বহুজাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা খ্যাতিমান প্রাণী সম্পদ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালের দিকে দেশে প্রথম চুক্তিভিত্তিক মুরগির খামার শুরু হয়। চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতীয় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানী এ ব্যবসা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলেও খামারিদের কাছ থেকে জামানত হিসেবে মোটা অংকের অগ্রীম টাকা নেয়াসহ জটিল বিভিন্ন শর্তের কারণে তেমনটা এগুতে পারছিল না এ ব্যবসা।

যেসব খামারি শুরু করেছিলেন তারাও মান সম্মত বাচ্চা, সুষম খাবার, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন/ওষুধ সরবরাহ, পরামর্শ সেবার ঘাটতিতে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে করনোর আঘাতে বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে পোলট্রি খাত।

ডাঃ হাফিজুর রহমান জানান, করোনা পরবর্তীতে এ খাতের খামারিদের সমস্যা চিহ্নিত করে বিনা জামানতে সহজ শর্তে ‘চুক্তিভিত্তিক খামার’ পরিচালনা শুরু করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস লিমিটেড। কোম্পানীটি তাদের নীতি সহায়তার মাধ্যমে ইতি মধ্যেই খামারিদের আস্থা অর্জন করেছে। পুরাতন খামারিদের পাশপাশি সারা দেশে শিক্ষিত বেকার যুবরাসহ অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারী পুরুষেরাও নতুন করে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে মুরগি উৎপাদনের ব্যাবসায় সম্পৃক্ত হচ্ছেন বলেও জানন এই বিশেষজ্ঞ।

সরকারী বেসরকারী তথ্য যাচাইয়ে ঢাকার নিকটবর্তী জেলা টাঙ্গালে সরেজমিনে বিভিন্ন খামার ঘুরে খামারিদের সাথেও কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তার মধ্যে অন্যতম টাঙ্গাইল সদর, বাসাইলের নারী উদ্যোক্তা ফিরোজা পোল্ট্রি ফার্মের স্বত্ত্বাধিকারী ফিরোজা বেগম। জানালেন, ‘ছেলের বেকারত্ব দূর করতে বাড়ির উপর ২টি ঘরে মুরগির খামার শুরু করেছিলাম। কখনো লাভ , কখনো লোকসান হয়েছে। কিন্তু এক দফায় খামারে রানীখেতের আক্রমনে অধিকাংশ মুরগি মারা যায়। তাতে লোকসান হয় ৫০ হাজার টাকার বেশি। পুঁজিও শেষ হয়ে যায়। তার পর একটি বিদেশী কোম্পানীর সাথে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যুক্ত হই, এর পর লোক মুখে খবর পেয়ে কাজী ফার্মের সাথে নতুন করে ব্যবসা শুরু করি। এখন দেড় হাজার মুরগি করে মাস গড়ালেই ব্যাংক একাউন্টে ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা আসে।’

কল্পনাতীত উপার্জনে উৎফুল্ল ফিরোজা জানান, ‘আগের কোম্পানীর বাচ্চা ৩০ দিনেও ১ কেজি হোত না, কাজী ফার্মসের বাচ্চা ৩৫ দিনে ২ কেজি ছাড়িয়ে যায়। তাদের (কাজী ফার্মস) বাচ্চা ভালো, খাবার ভালো, ফলন ভালো নিয়মিত সপ্তাহে ডাক্তার আসে ২দিন। এরপরও সমস্যা হলে ফোন করলেই ওষুধ/ ভ্যাকসিনসহ ডাক্তার চলে আসে।’

ফিরোজা বেগম স্বগৌরবে জানান, ‘এখন আমাদের দুর্ভাবনা কেটে গেছে, ছেলেকে ইটালী পাঠিয়েছি। স্বামী নিজেদের জমিতে কৃষি কাজ করেন, ছেলের বৌকে নিয়ে আমি মুরগির খামার সামলাই।’ জেলার সদরের এনায়েতপুরের খামারি মোঃ রোকোনুজ্জামান। মুরগির খামারের নানা পর্যায়ে অম্ল মধুর অভিজ্ঞতার বর্ণনা শেষে জানালেন, ‘ছয় বছর ধরে ব্রয়লার মুরগি লালন পালন করছি। প্রথমে দুই বছর নিজের পুঁজিতে লোকসান না হলেও লাভ হয়নি তেমন। পরের দুই বছর বিদেশী কোম্পানীর সাথে চুক্তি ভিত্তিক খামার করে যা পাচ্ছিলাম তা আশানারূপ ছিলো না। তবে করোনার পর থেকে কাজী ফার্মসের সাথে বিনা পুঁজিতে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে ক্রমেই লাভের অংকটা বড় হচ্ছে।’

আসমা পোল্ট্রি ফার্মের স্বতাধিকারী এই রোকোনুজ্জামান আরো জানান, ‘কাজীর সাথে ব্যাবসায় প্রথম ব্যাচে ৩ হাজার মুরগি করে ৩৫ দিন শেষে পেয়েছি ৮৩ হাজার টাকা। এর পর প্রত্যেক ব্যাচেই আয় বেড়ে ১১তম ব্যাচে পেয়েছি ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৪ টাকা। যা আমারমত দ্বাদশ পাস করা কারো পক্ষে সৎ থেকে চাকরি বা ব্যবসা করে আয় করা অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘ব্রয়লার খামারের অর্থ হচ্ছে জীবন নিয়ে খেলা। নিজের পুঁজিতে ঝুঁকি নিশ্চিৎ আর আয় অনিশ্চিৎ। আর কন্ট্রাক্ট ফার্মিং অর্থ হচ্ছে বিনা পুঁজিতে বড় অংকের আয়। নিজের ঘরে থেকে খেয়ে কোম্পানীর টাকা নিজের একাউন্টে জমা করা।’

কাজী ফার্মস লিমিটেডের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, সামর্থ বিবেচনায় ঝুঁকি মুক্তভাবে মুরগির খামার সচল রাখতে কাজী ফারর্মস কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। উৎপাদন ও বাজার ভাল হলে কোম্পানী ও খামারি উভয়ে লাভবান হবে। পোলট্্ির খাবারের দামবৃদ্ধিসহ নানা করণে উৎপাদন খরচ বাড়লে অথবা মুরগির বাজার দর কমলেও খামারির কোনো ক্ষতি নেই। নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত হারে গ্রোয়িং ফী পাচ্ছেন খামারি।

তিনি জানান, খামারে কোনো কারণে মুরগি মারা গেলে তার দায়ও নেবে কোম্পানী। কেজিতে সর্ব নিন্ম ৬ টাকা থেকে ২৩ টাকা হারেও গ্রোয়িং ফী পাচ্ছেন খামারিরা। খামারে যারা যত বেশি সচেতন ও যত্নবান মুনাফাও তারা ততো বেশি পান।