সহজে আবাদযোগ্য অর্থকরী ফল কলা। আজকের আয়োজন এর নানা দিক নিয়ে বারোমাসি ও সহজলভ্য ফল কলা। প্রাচীনকাল থেকেই এ ফলের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে কলা অন্যতম প্রধান ফল হিসেবে বিবেচিত। দেশের চাষিরা কলা চাষে কিছু কৌশল অবলম্বন করে থাকেন।
জাত নির্বাচন
কলা চাষের শুরুতে জাত নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৫০টি জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। এসব জাতের মধ্যে অমৃতসাগর, সবরি, কবরি, চাঁপা, সিঙ্গাপুরি বা কাবুলী, মেহেরসাগর, এঁটে বা বিচিকলা, কাঁচকলা বা আনাজি কলা ও জাহাজি কলা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বারিকলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে তিনটি উন্নত জাত অবমুক্ত করা হয়েছে।
বারি কলা-১ জাতের কলা দেখতে উজ্জ্বল হলুদ রঙের, খেতে মিষ্টি। এ জাতের ফলন একটু বেশিই হয়। বারি কলা-২ জাতের কলা কাঁচা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ জাতের আকার মাঝারি ও রং গাঢ় সবুজ প্রকৃতির। এর ফলন বারি কলা-১ জাতের থেকে একটু কম। বারি কলা-৩ জাতটিও মাঝারি আকারের। এ জাতের কলা পাকা হয়। সম্পূর্ণ বীজছাড়া। কলার শাঁস মিষ্টি ও আঠালো। এর গড় ফলন বারি কলা-২ জাতের মতোই।
মাটি ও জলবায়ু
প্রায় সব ধরনের মাটিতে কলার চাষ করা যায়। তবে পর্যাপ্ত রস আছে এমন মাটিতে কলা চাষ করা উত্তম। এছাড়া সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিও নির্বাচন করা যেতে পারে। নিচু জমি হলেও সমস্যা নেই। খেয়াল রাখতে হবে জমিটি যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাসপূর্ণ হয়। শীতকাল ও আর্দ্রতাযুক্ত জলবায়ুতে কলাগাছের বৃদ্ধি ভালো হয়।
চারা নির্বাচন
কলার চারা দুই রকমের অসি চারা ও পানি চারা। অসি চারার পাতা চিকন, গোড়ার দিকে মোটা ও গোলাকার। পানির চারার পাতা চওড়া, কাণ্ড চিকন ও দুর্বল। তবে চাষের জন্য অসি চারা উত্তম।
চারা রোপণ
ভাদ্র ছাড়া যে কোনো মাসে চারা রোপণ করা যায়। তবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ ও মধ্য মাঘ থেকে মধ্য চৈত্র। তিন মাস বয়সি সুস্থ-সবল অসি চারা বেছে নিতে হবে। চারা রোপণের আগে জমি ভালোভাবে গভীর করে দুই থেকে তিনবার চাষ করে জৈব সার ছিটিয়ে কয়েক দিন ফেলে রাখতে হবে। এরপর দুই মিটার করে দূরত্ব রেখে ৬৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও গভীর করে গর্ত তৈরি করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে গোবর, টিএসপি ও ইউরিয়া সার ছিটিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। রোপণের সময় গোড়ার কাটা অংশটি দক্ষিণ দিকে রেখে রোপণ করা উচিত। এতে কলার কাঁদি বা থোরা উত্তর দিকে পড়বে। ফলে কলার রং সুন্দর হয়। ঝড়বাদল থেকেও রক্ষা পায়।
পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ
কলা চাষে তেমন পরিশ্রম না থাকলেও ভালো ফলনের জন্য শ্রম দিতে হবে। গাছ রোপণের পর পরিচর্যায় অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে। তাহলে যথাসময়ে অধিক ফল সংগ্রহ করা যাবে।
পরিচর্যা
শুকনো মৌসুমে গাছ রোপণ করলে ১৫ থেকে ২০ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। আর বর্ষাকালে রোপণ করলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। কলাগাছে প্রচুর পানির প্রয়োজন। তবে অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। তাই নিষ্কাশনের জন্য নালা কেটে রাখতে হবে। গাছ বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থায় বিশেষ করে রোপণের প্রথম চার মাস কলা বাগান অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। কলার পুরোনো পাতা পরিষ্কার করতে হবে।
গাছে থোড় আসার সময়ে যদি গাছের নতুন চারা গজায়, সেগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। কলার থোড় আসার পরপরই গাছ যাতে বাতাসে ভেঙে না যায় সেজন্য বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাতাসের বিপরীত দিক থেকে গাছে ঠেস দিয়ে রাখতে হবে। থোড় থেকে কলা বের হওয়ার আগেই গোটা থোড় স্বচ্ছ বা সবুজ পলি ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পলিব্যাগের নিচের দিকের মুখ একটু খোলা রাখতে হবে। এ সময় প্রয়োজন পড়লে কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনমতে স্থানীয় কৃষি অধিদফতরের পরামর্শ নিতে হবে।
চারা রোপণের প্রথম চার থেকে পাঁচ মাস কলা বাগান ফাঁকা রাখতে হবে। এরপর বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে সবজি চাষ করা যেতে পারে। তবে এসব আন্তঃফসলের জন্য অতিরিক্ত সার দরকার। আন্তঃফসল হিসেবে কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শসা, শাকজাতীয় ফসল উৎপাদন করা যায়।
ফসল সংগ্রহ
রোপণের পর ১১ থেকে ১৫ মাসের মধ্যেই সাধারণত সব জাতের কলা পরিপক্ব হয়ে ওঠে। গাছের কুঁড়ি থেকে পরিপক্ব কলা কেটে সাবধানে নামাতে হবে। কলার থোড় সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে চটের বস্তা বিছিয়ে এর ওপরে রেখে দিতে হবে। থোড় কেটে নেওয়ার পর গাছের মাঝ বরাবর কেটে ফেলতে হবে। সেখান থেকে আবার নতুন চারা গজাবে।