কুষ্টিয়ায় অবৈধ কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ নিধন চলছে। এসব কারেন্ট জালে জেলার নদ-নদী ও খাল-বিলে অবাধে মাছ ধরছেন জেলেসহ নানা শ্রেণির মানুষ। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে ডিমওয়ালা ও ছোট পোনা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী অকালে মরে যাচ্ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। হারাতে বসেছে মাছের অভয়াশ্রম।
সম্প্রতি কুমারখালী উপজেলার চৌরঙ্গী, পান্টি, বাঁশগ্রাম ও শেরকান্দির সাপ্তাহিক হাটবাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রকাশ্যে কেনাবেচা চলছে অবৈধ কারেন্ট জাল।
পান্টি হাটের জাল বিক্রেতা বিল্লাল হোসেন বলেন, তিনি পদ্মা নদীর জোতপাড়া কোল এলাকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। মাছ ধরার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন হাটে কারেন্ট জাল বিক্রি করেন। প্রতি হাত জাল চার থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি স্বীকার করেন, কারেন্ট জাল বিক্রি অবৈধ, তবুও তিনি বাড়তি আয়ের জন্য একাজ করে থাকেন।
শ্রী গেদা চন্দ্র দাস (৬৫) পেশায় একজন বাঁশ ও বেতশিল্পের কারিগর। তিনি প্রায় ৫৫ বছর ধরে বাঁশ ও বেত দিয়ে মাছ ধরার দেশীয় ফাঁদ চাঁই, পলো এবং গৃহস্থালি কাজের জন্য ঝাঁকা, খাঁচা, দাঁড়িপাল্লাসহ নানা তৈজসপত্র তৈরি করে আসছেন। কিন্তু গত তিন-চার বছর তিনি আর মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করেন না।
তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের ভালুকা দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার ভাষ্য, বাজার এখন নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের দখলে। কারেন্ট জাল দিয়ে সহজেই বেশি মাছ ধরা যায়। তাই মানুষ এখন চাঁই কিনতে চায় না। এছাড়া আধুনিক এ সময়ে তার পৈতৃক পেশাটা অনেকটাই কোণঠাসা।
একই এলাকার কারিগর শ্রী কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, প্রতি হাটে খোলামেলাভাবে কারেন্ট জাল ও চায়না দুয়ারি জাল বিক্রি হয়। কেউ তাদের কিছু বলে না। অবৈধ জালের জন্য দেশীয় প্রজাতির মাছ ও কারিগররা চরম বিপদে আছে।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টিপাত ও বর্ষায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলার গড়াই ও পদ্মা নদী এবং নদীর কোল ও খাল-বিলে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। এসব মাছের মধ্যে কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, চাঁদা, খলসি, টাকি ইত্যাদি রয়েছে। পানি বাড়লেই মৎস্যজীবীদের তৎপরতা বাড়ে বহুগুণ। সে সময় বাঁশের তৈরি মাছ ধরার দেশীয় উপকরণ এবং অবৈধ চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জালে সয়লাব হয়ে যায় বাজার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গড়াই নদী, পদ্মা নদী ও পদ্মার কোল এলাকায় মাছের উš§ুক্ত অভয়াশ্রম রয়েছে। সেখানে সারাবছরই নিষিদ্ধ কারেন্ট ও চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ ধরেন জেলে ও অন্যরা।
সম্প্রতি উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পদ্মা নদীর জোতপাড়া কোল এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় ১০০ একর জমি নিয়ে কোল। সেখানে জেলেরা শত শত চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জাল নিয়ে মাছ ধরছে।
এ সময় জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার মো. আবুল কালাম বলেন, নামেই মাছের উš§ুক্ত অভয়াশ্রম, কিন্তু বাস্তবে নেই। জেলেরা কোল ইজারা নিয়ে অবৈধ কারেন্ট ও দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ মারেন। আবার পানি সেচে সব মাছ তুলে নেন। এতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। অনেক মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
বয়োজ্যেষ্ঠ জেলে হায়াত আলী বলেন, ৭০ জেলে সমিতি গঠনের মাধ্যমে পদ্মা নদীর কোল লিজ (ইজারা) নিয়ে মাছ ধরে সংসার চালান। তিনি কোনো অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরেন না।
তিনি জানান, জেলে সমিতির সভাপতি আব্দুল বারিক ও অন্যরা চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মাছ ধরেন।
তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি সমিতির সভাপতি আব্দুল বারিক।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, কুষ্টিয়া জেলায় মোট ১১টি নদী রয়েছে। এ ছাড়ারও ৫৪টি বিল, তিনটি বাঁওড় এবং ১২ হাজার ৪৩০টি পুকুর রয়েছে। জেলায় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সংখ্যা ৩২টি এবং মৎস্যজীবীর সংখ্যা তিন হাজার ৯৬০।
এ বিষয়ে গবেষক ও পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, নিষিদ্ধ জালের প্রভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও উৎপাদন কমছে। ডিমওয়ালা ও ছোট পোনা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী অকালে মারা যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধের দাবি জানান তিনি।
উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নদ-নদী, খাল-বিল, প্লাবন ভূমি, বাঁওড় ও পুকুরসহ সেখানে চার হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষাবাদ হয়। গত অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার ৫৭২ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে উপজেলায়।
কুমারখালী উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, চায়না দুয়ারি এক ধরনের ফাঁদ। এটার মধ্যে রেণু পোনাসহ সব মাছ ও প্রাকৃতিক জলজ প্রাণী আটকে পড়ে এবং এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কারেন্ট জালও একইভাবে ক্ষতিকর। অভিযোগ পেলেই তিনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবৈধ জাল জব্দ, বিনষ্ট ও জেল-জরিমানার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মৎস্য কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।