মাছ এখন গরীবের সাধ্যের বাইরে

141

বেশিদিন আগের কথা নয়। বছরখানেক আগে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বাজারে গেলে মাছ কিনতেন ইচ্ছামতো। কখনও তিন কেজি, কখনও পাঁচ কেজি। তখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজা করে মাছ খেতে পারতেন। গতকাল বৃহস্পতিবার মিরপুরের বসুপাড়া বাজারে তার সঙ্গে কথা হলে এমনটিই বলছিলেন। এরপর হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে আর আগের মতো মাছ কিনতে পারি না। এখন এক কেজি বা বড় জোর দুই কেজি মাছ কিনি। তাও আবার মাসে এক থেকে সর্বোচ্চ দুইবার। এগুলো দিয়েই মাছের চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে।’

বেসরকারি এই চাকরিজীবী বলেন, ‘আগে দুই বেলা দুই টুকরা দিয়ে সুন্দর ভাত খেয়েছি। আর এখন! একটা মাছের পিসকে দুই টুকরা করে, আধা টুকরা এক বেলা আর অন্য আধা টুকরা আরেক বেলা খাই। বাচ্চাদেরও তা-ই খাওয়াচ্ছি। কী করব! মাছের যে দাম বেড়েছে, এতে আগের মতো খাওয়ার অবস্থা নেই। সবকিছুর দাম যে হারে বাড়ছে, সেই হারে তো আমার বেতন বাড়েনি। তাইলে কীভাবে এই ঘাটতি পূরণ করব?’

রাজধানীর মিরপুর, কারওয়ান বাজার, বাড্ডাসহ আরও বেশকিছু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছের চড়া দাম এখনও বহাল। অন্যান্য নিত্যপণ্যের পাশাপাশি মাছের ঊর্ধ্বগতির কারণে বহু মানুষ মাছ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আগের তুলনায় মাছের বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে। কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা জসিম উদ্দিন  বলেন, ‘মাছের দাম অনেক কারণে বেশি। আগের তুলনায় গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। আগে ৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া ছিল, সেটা এখন ৭ হাজারের বেশি পড়ে। এছাড়া পথে পথে সবকিছুর দামই বেড়েছে। তাই মাছের দামের ওপর এর প্রভাব পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মাছের দাম বেশি থাকলে আমাদের বিক্রি কমে। দাম যত কম থাকে আমাদের বিক্রি তত বাড়ে। যে দুই মাছ কিনত সে দাম বাড়ার কারণে এক কেজি মাছ কিনছে। যে ১০ কেজি মাছ কিনত, সে এখন পাঁচ কেজি মাছ কিনছে। এতে করে আমাদের ব্যবসার ওপরও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই আমরাও চাই মাছের দাম কম থাকুক। বাজারে ছোট আকারের রুই মাছ প্রতি কেজি পড়ছে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। যে মাছ বছরখানেক আগেও দাম ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। আর বড় আকারের রুইয়ের দাম ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা, যা এক বছর বা তারও কম সময় আগে ছিল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে প্রতি কেজি।’

দাম বৃদ্ধি সিন্ডিকেটের কারণে, বলছেন মাছ বিক্রেতারা: বাড্ডা বাজারের মাছ বিক্রেতা শাহিন শেখ মাছের দাম বৃদ্ধির কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আসলে দাম সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হচ্ছে। সবকিছুর সঙ্গে সিন্ডিকেট জড়িত। মাছ গ্রাম থেকে শহরে আসা পর্যন্ত প্রত্যেক ধাপে সিন্ডিকেট জড়িত। এই সিন্ডিকেট না থাকলে মাছের দাম হয়তো আরও কিছুটা কম থাকত। তাদের কারণে দাম বেশি থাকায় আমাদের বিক্রিও কম।’

বাজার ঘুরে দেখা যায়, ইলিশের দাম সবচেয়ে বেশি। প্রতি কেজি মাঝারি আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়; যা বছর খানেক আগেও ছিল এক হাজারের মধ্যে। আর বড় আকারের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৬৫০ টাকা।

ইলিশ কিনতে আসা সরকারি চাকরিজীবী সফিকুর রহমান নামে একজন ক্রেতা বলেন, ‘বড় সাইজের দুটি ইলিশ কিনলাম। ৩ হাজার ৪৫০ টাকা এসেছে দাম। আগে ৫টা বা ৬টা একসঙ্গে কিনতাম। এখন দাম বেশি হওয়ায় এতগুলো কিনছি না। এই দামে ইলিশ খাওয়া নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য সত্যিই অনেক টাকা। মাছসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের যে দাম, এতে ভালো কিছু খেয়ে বেঁচে থাকায় দায়।’

রুই ইলিশের পাশাপাশি অন্যান্য মাছের দামও বেশ চড়া। বাজার ঘুরে দেখা যায়, রূপচাঁদা ১ হাজার টাকা, পাঙাশ ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, কাতল মাছের কেজি ৪৫০ টাকা, হাইব্রিড জাতীয় বড় কৈ মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা, শিং মাছ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং ভালো মানের চিংড়ি প্রতি কেজি ৮০০ থেকে হাজার টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকা মৎস্য আড়ত মালিকদের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, ‘আগে নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলত। এসব ইলিশ স্থানীয় বাজারে প্রান্তিক জেলেরা সরাসরি বিক্রি করতেন। এখন প্রান্তিক আড়তে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। কম দামে মাছ পাওয়া যায় না। আবার ঢাকায়ও বাজারজাত খরচ ধাপে ধাপে বেড়েছে। বরফের দাম গত তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আড়তে শ্রমিকরা কম খরচে কাজ করেন না। গাড়ির ভাড়া বেড়েছে। বাজারের ইজারা, ভাড়া এসব কিছু মিলিয়েই মাছের দাম বেড়ে যাচ্ছে।’