বন মোরগ পালনে পাহাড়ি দম্পতির ভাগ্যবদল

146

পাঁচ বছর আগের কথা। পাহাড়ে জুম কাটতে যাওয়ার সময় ৬-৭টি ডিমসহ একটি বনমুরগির বাসা দেখতে পান এক দম্পতি। সেখান থেকে তিনটি ডিম নিয়ে এসে ঘরে ‘তা’ দিতে থাকা দেশি মুরগির বাসায় রেখে দেন। তার মধ্যে ১টি ডিম পচে যায় আর দুইটি ডিম থেকে একটি মোরগ ও একটি মুরগির বাচ্চা ফুটে। এ দুই বাচ্চা দেশি মুরগির সঙ্গে বড় হতে থাকে। এ দুই বাচ্চা থেকে পাঁচ বছরে প্রায় দেড়শ বনমুরগি হয়েছে।

নিজেদের ঘরের চারপাশে বেড়া দিয়ে বিভিন্ন গাছগাছালির লাগিয়ে বনের পরিবেশ তৈরি করেছে। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে বনমোরগ-মুরগির খামার করেছেন এই দম্পতি।

এ দম্পতির নাম হ্লা শোয়ে অং মারমা (৪০)ও শোয়ে মে চিং (৩৬)—ইতোমধ্যে বনমোরগ পালন করে তাক লাগিয়েছেন তারা। বান্দরবান সদর উপজেলার ১নং রাজবিলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেওয়া পাড়া এলাকার বাসিন্দা তারা।

স্থানীয়রা জানান,সাধারণত গহীন বনে থাকে বনমোরগ-মুরগি। তারা মানুষের আওয়াজ পেলে উড়াল দেয়। আর সেই বনের প্রাণীকে ঘরে রেখে পালন করা সহজ বিষয় নয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে মেওয়া পাড়া এলাকায় গেলে হ্লা শোয়ে অং মারমা ও শোয়ে মে চিংয়ের সঙ্গে ঢাকা মেইলের কথা হয়। লেখাপড়া না জানেন না তারা। বাংলাও বলতে পারেন না। মারমা ভাষা জানা এ দম্পতি জানান, ৫ বছর আগে পাহাড়ে জুম কাটতে যাওয়ার সময় ৬-৭টি ডিমসহ একটি বন মুরগির বাসা দেখতে পান তারা। সেখান থেকে তিনটি ডিম নিয়ে আসেন। ঘরে ‘তা’ দিতে থাকা দেশি মুরগি বাসায় রেখে দেন। সেখান থেকে ১টা ডিম পচে যায় আর দুটো ডিম থেকে একটি মোরগ-একটি মুরগি বাচ্চা ফুটে। এরপর তারা দেশি মুরগী মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে।

একদিন তারা দেখতে পান বনমুরগির বাচ্চা দুটো মৃতপ্রায় অবস্থায় ঘাসে পড়ে আছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল এ দম্পত্তির। বাচ্চা দুটোকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন। পাহাড়ি লতা-পাতা থেকে শুরু করে বনৌষধি খাওয়ালেন। কোনোভাবে বাচ্চা দু্ইটি সুস্থ হচ্ছে না।
এভাবে ৩-৪ ঘণ্টা কেটে গেল। কোনো উপায় না পেয়ে ধানের শক্ত দানা খাওয়ালেন। এছাড়া পাশের জঙ্গলে গিয়ে পিঁপড়ে ডিমসহ হরেক রকম পোকা-মাকড় এনে খাওয়ানোর পর ওই বাচ্চা দুটো অনেকটা সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা করছে। আর ছোট-ছোট পাখাগুলোও নাড়াচাড়া করছে।
বাচ্চা দুটো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেখে হ্লা শোয়ে অং মারমা ও শোয়ে মে চিং আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। তারা খুশিতে কেঁদে ফেলেন।

ওই দম্পত্তি তখন বুঝলেন দেশি মুরগীর মতো নরম ভাতের সঙ্গে ভূষি মিশিয়ে খাওয়া দিলে পাতলা পায়খানা হয় আর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন থেকে বাচ্চা দুটো একটু আলাদাভাবে যত্ন নেওয়া শুরু করলেন। ঘাসের ফড়িং, পোকামাকড়, আর ধানের দানা দিলে খুব দ্রুত খেয়ে ফেলে এবং অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে। এরপর থেকে তাদেরকে আলাদাভাবে খাবার দিতে শুরু করেন।

এভাবে তাদের বনমোরগের খামার ‘তোয়াইং গ্যাং’ খামার গড়ে উঠে। স্থানীয়ভাবে বনমুরগিকে ‘তহ্ক্রাক’, পোষমানা মুরগিকে ‘তোয়াইং গ্যাং’ বা ‘তইক ক্যাং’ বলা হয়। গত পাঁচ বছরে তাদের খামারে দেড়শ বনমুরগি উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ২২টি পরিপক্ক মুরগি, ১৩টি পরিপক্ক মোরগ, ২টি শিকারি মোরগ, ১৭টি বাচ্চাসহ তিনটি মা, ৯টি ডিম নিয়ে ‘তা’ দেওয়া মা আছে একটি।

হ্লা শোয়ে অং মারমা জানান, একটি পরিপক্ক মোরগ তিন হাজার, মুরগি ১ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এ বছর ৮টি মুরগি ও ৫টি মোরগ বিক্রি করেছেন তারা।

তিনি আরও জানান, ওজন দেশি মুরগির মতো নয়। এদের সাইজ দেশি মুরগীর তুলনায় ছোট এবং ওজনও কম। পরিপক্ক মোরগের ওজন সর্বোচ্চ ৭শ থেকে ৮শ গ্রাম হয়। আর মুরগির ওজন ৬শ থেকে ৭শ গ্রাম হয়ে থাকে। তবে মা মুরগির ক্ষেত্রে ডিম থাকলে ওজন একটু বেশি হতে পারে বলে জানান তিনি।

হ্লা শোয়ে অং মারমা বলেন, ছোট-মাঝারি-ও বড় মিলে ৫৫টি মুরগীর জন্য প্রতিদিন ৬ কেজি ধানের প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যতে এ খামারকে আরও বড় ও বাণিজ্যিক খামার হিসেবে গড়ে তুলতে চান হ্লা শোয়ে অং মারমা ও শোয়ে মে চিং।

বন বিভাগের বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরাসরি বন থেকে বন্যপ্রাণীকে ধরে নিয়ে এসে বাসা-বাড়িতে রাখলে বা পোষমানার চেষ্টা করলে সেটা বন্যপ্রাণী নিধন আইনে অপরাধী হবেন। আর যদি কোনো বন্যপ্রাণীর সঙ্গে গৃহপালিত মুরগি, প্রাণীর সঙ্গে ক্রস হয়ে গৃহেই থেকে যায়। পরবর্তীতে গৃহেই বংশবৃদ্ধি করে, তখন সেটা গৃহপালিত পশু বা পাখি হিসেবে ধরা হয়। আর যে বন্য মুরগির কথা বলা হয়েছে, সেটির ক্ষেত্রে মুরগিগুলো একপ্রকার গৃহপালিতই বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, এ দম্পতি নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে। তাদের ঘরে থাকা ৫০-১০০টা মুরগিগুলো যদি ঘরেই উৎপাদন হয়ে থাকে তাহলে সেটা বন্য আইনে অপরাধী হবে না। কেননা ওই মুরগিগুলো একপ্রকার দেশি মুরগী বা ঘরের মুরগি হয়ে গেছে।

জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. পলাশ কান্তি চাকমা জানান, আমরা সাধারণত মুরগী মুক্ত, অর্ধমুক্ত ও বন্দি অবস্থায় পালন করি। দেশি মুরগীর মতো বন মোরগের রোগ বালাই কম, তবে রানিক্ষেত, কলেরা, ফক্স এই রোগগুলো হয়ে থাকে। যদিও ভ্যাকসিন দিলে এই রোগ থেকেও প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।

খামারি যদি প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ে এসে যোগাযোগ করেন, তাহলে চিকিৎসা ও পরিচর্চার ক্ষেত্রে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।