মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য হাজারী গুড়। মন মাতানো সুগন্ধ আর স্বাদে অতুলনীয় এই গুড় যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার। স্বাদের পাশাপাশি এই গুড়ের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে হাতে নিয়ে চাপ দিতেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে হাজারী গুড়ের সুনাম। তবে দিন দিন খেজুর গাছ কমতে থাকায় উৎপাদন কমছে হাজারী গুড়ের। উৎপাদন বাড়াতে জেলাব্যাপী খেজুর গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কথিত আছে, ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হাজারী গুড় খেয়ে অভিভূত হয়ে দিয়েছিলেন হাজারী নাম লেখা একটি সিলমোহরও। শতবছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এই গুড়ের নামেই করা হয়েছে জেলার ব্র্যান্ডিং ‘লোকসংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর।’
গুড় তৈরির প্রক্রিয়া জানতে সরেজমিনে হরিরামপুরের ঝিটকা শিকদারপাড়া গ্রামের জাহিদ হাজারী, রহিজ হাজারী ও গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া গ্রামের শফিকুল হাজারী ও মোজাফফর হাজারীর সঙ্গে কথা হয়।
তারা জানান, আগের দিন বিকেলে হাঁড়ি ধুয়ে খেজুর গাছে বাঁধা হয়। পরদিন ভোরে খেজুর গাছ থেকে সেই হাঁড়ি নামিয়ে আনার পরে রস সংগ্রহ করা হয়। এর পর মাটির হাঁড়ি অথবা টিনের তাফালে আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট রস জ্বাল দেওয়ার পর প্রথম সাজ মাটির হাঁড়িতে ঢালা হয়। এরপর তা জোড়ে জোড়ে প্রায় ৩০ মিনিট ঘোটার পর রসের ঘনত্ব বেড়ে আঠালো হয়। এরপর আঠালো রসের সঙ্গে আবারও জ্বাল করা রস (দ্বিতীয় সাজ) মাটির হাঁড়িতে ঢালা হয়। এরপর ৫-৭ মিনিট ঘোটার পর সেই রসে ছোট পাত্রে ঢালার কিছুক্ষণ পর ‘হাজারী’ লেখা সংবলিত সিল দেওয়া হয়।
এই গুড় কিনতে হলে অন্তত এক সপ্তাহ আগে অর্ডার দিতে হয়। প্রতি কেজি হাজারী গুড় এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। হরিরামপুরের ঝিটকা শিকদারপাড়া ও গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া গ্রামের ৩০টি গাছি পরিবার এখনো শত বছরের ঐতিহ্য হাজারী গুড় তৈরির সঙ্গে জড়িত।
হাজারী বাড়ির সন্তান জাহিদ হাজারী বলেন, আমার বাবার কাছ থেকে খেঁজুর গাছ কাটা শিখেছি। সাত পুরুষ ধরে আমরা এই হাজারী গুড় তৈরি করে আসছি। তবে আগের মতো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায় না। গাছের সংকট আর রস কম হওয়ায় গুড় উৎপাদন কম হলেও হাজারী গুড়ের চাহিদা কমেনি। আবহাওয়া ভালো থাকলে গাছ থেকে বেশি রসও পাওয়া যায়, আর গুড়টাও ভালো হয়। প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৭ কেজি গুড় তৈরি করা যায়।
একই গ্রামের সিদ্দিক গাছির স্ত্রী শাহেদা বলেন, এলাকায় খেজুর গাছ কমার সঙ্গে এখন গাছিও কমে যাচ্ছে, গাছি তো তৈরি হচ্ছে না। আমার বাড়িওয়ালা গাছ কাটতে পারে বলেই গুড় তৈরি করতে পারছি। আমার এক ছেলে। সে এই কাজ শিখে নাই। গুড় তৈরির জন্য খেজুর গাছ কেনাসহ সকল সরঞ্জামই কিনতে হয়, সবকিছুরই দাম এখন বাড়তি। তেমন লাভ না থাকলেও পরিবার নিয়ে চলতে পারি।
গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া গ্রামের শফিকুল হাজারী বলেন, প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক থেকে শুরু হয় খেঁজুর রস সংগ্রহ। পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাসে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। তিন থেকে সাড়ে তিন মাস খেজুর রস থেকে হাজারী গুড় তৈরি করা হয়। তবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি আর খেঁজুর গাছ কমে যাওয়া আগের মতো রসও হয় না, গুড়ও কম তৈরি হয়। এ বছর প্রতিটি খেজুর গাছ ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়েছে। এ ছাড়া গাছিকেও মজুরি বেশি দিতে হয়। এক কেজি হাজারী গুড় তৈরির জন্য ১২ কেজি রস লাগে। এক সাজে ২৪ কেজি রস হলে দুই কেজি গুড় তৈরি করা যায়। কাজটি অনেক পরিশ্রমের হওয়াতে এখন তেমন গাছিও পাওয়া যায় না।
হাজারী পরিবারের রহিজ হাজারী বলেন, হাজারী গুড়ের অনেক চাহিদা থাকলেও উৎপাদন কম। প্রতিদিন ১০০ কেজি গুড়ের অর্ডার থাকলেও তৈরি হয় ৬০ থেকে ৭০ কেজি গুড়। এ বছর গুড়ের চাহিদ বেশি থাকলেও উৎপাদন কম। শুধু দেশেই নয়, গুড়ের জন্য বিদেশ থেকেও ফোন করে। এ বছর প্রতিটা গাছির খেজুর গাছ কেনা, হাঁড়ি, জ্বালা, জ্বালানিসহ গুড় তৈরির বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হবে। এ বছর প্রতি কেজি হাজারী গুড় ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাজারী প্রামাণিক থেকে শুরু করে আমরা সাত পুরুষ এই গুড় তৈরি করে আসছি।
এদিকে জেলার শত বছরের এই ঐতিহ্য হাজারী গুড়ের সুনাম ধরে রাখতে পাঁচ লাখ খেজুর গাছের চারা রোপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ খেজুর গাছের চারা জেলাব্যাপী রোপণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি চারাগুলোও রোপণ করা হবে। এছাড়া চলতি মাসের ৮ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ৩-দিনব্যাপী শ্যামল ঐতিহ্যে মানিকগঞ্জ স্লোগানে হাজারী গুড় মেলার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার বলেন, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলাতেই ঐতিহ্যবাহী এই হাজারী গুড় তৈরি হয়। এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং এর উৎপাদন বাড়াতে জেলাজুড়ে পাঁচ লাখ খেজুর গাছের চারা রোপণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে প্রায় ১ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া এই গুড় তৈরির কারিগরদের(গাছি) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। যাতে কারিগররা(গাছি) হাজারী গুড়ের গুণগত মান বজায় রাখতে পারে। হরিরামপুর উপজেলাকে হাজারী পল্লী হিসেবে গড়ে তোলা হবে।