ধানের ফলন ভালো হলেও, দাম নিয়ে শঙ্কায় চাষীরা

112

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের চারদিকে শোভা পাচ্ছে একের পর এক ধানক্ষেত। সবুজে ঢাকা বোরো ক্ষেতের পরিচর্যার সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন চাষিরা। সহায়ক আবহাওয়ার কারণে এবার ভালো ফলনের আশাও করছেন তারা। তবে ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে বরাবরের মতো এবারও হিসাব-নিকাশ কষছেন অনেকেই।

এদিকে নিয়মিত পরিচর্যায় বোরো ধানক্ষেতগুলো এখন পর্যন্ত আশার আলো দেখালেও আবহাওয়ার গতিবিধির ওপর নির্ভর করছে ফসলের ভবিষ্যৎ। বিস্তৃত ফসলের মাঠজুড়ে সবুজের চাদরে ভরছে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের ক্ষেতগুলো। সবুজের সমারোহ দেখে চাষিদের মুখে ফুটছে হাসি, তারা বুকে বুনছেন সোনালি স্বপ্ন। তবে সার, সেচ ও কীটনাশক ব্যবহারে খরচের হিসাব গুনে ধানের দাম নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভালো ফলনের আশায় ফসলের মাঠে চাষিরা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। তবে খরাময় প্রকৃতিতে এখন বৃষ্টি ঝরার সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসায় কোথাও কোথাও চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ফলন ভালো হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রংপুর জেলায় চাষযোগ্য আবাদি জমি এক লাখ ৮৯ হাজার ৫১৪ হেক্টর। এবার জেলায় বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ৮০১ মেট্রিক টন চাল। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ফলন বেশি হবে। আগাম বোরো জাতের ধান মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কর্তন করা হবে। এ ছাড়া আউশ ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৩০ হাজার হেক্টর। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৯২৫ মেট্রিক টন চাল।

বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের তেলীপাড়া গ্রামের কৃষক আলমগীর বাদশা বলেন, বোরো ধানের ফলন এবার ভালো হওয়ার কথা, কিন্তু ধানচাষিরা ধান বিক্রি করে খরচ তুলতে পারেন না। এ বছর খরার কারণে দ্বিগুণ সেচ দিতে হচ্ছে জমিতে। এ কারণে সার ও সেচের খরচ বেড়েছে। এ বিষয়টা সরকারের ভেবে দেখা উচিত, যাতে আমরা কৃষকরা ন্যায্য দাম পাই, সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে দাম নির্ধারণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা যাতে কৃষকের ঘামে উৎপাদিত সোনালি ধানের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট করতে না পারে, এটা প্রান্তিক পর্যায়ে নিশ্চিত করা উচিত।

তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের জগদীশপুর ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী বলেন, আমরা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঠিকভাবে পরামর্শ দিচ্ছি। আগাম উচ্চ ফলনশীল ধান ও দুই ফসলি জমিতে জিংক প্রোটিনসমৃদ্ধ ধান চাষে আমরা কৃষকদের সরকারি সহায়তা উদ্বুদ্ধ করছি। এবার সোনালি ধানে বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরা। আশা করছি তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় রোগবালাই কম হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদনে খরচ কমে হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি।

গংগাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ শাহিনুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মাঠে খোঁজখবর নিয়েছি। বোরো ধানের এবার ভালো ফলন হবে। মাঠপর্যায়ে বোরো মৌসুমে ব্রি-ধান জিংসমৃদ্ধ ৭৪, ৮৪, বঙ্গবন্ধু ১০০। উচ্চ ফলনশীল ব্রি-ধান ২৮, ২৯, ৮৮, ৯২, ৯৬, ১০০, ১০২, ১০৩ ও বিআর ১৪। আউশ হিসেবে ব্রি-ধান ৯৮, ৮৫, ৮৭, বিনা ২০ ও ২১ চাষ হচ্ছে। বিরূপ আবহওয়ার কারণে সেচ বেশি লেগেছে, তবে নেক ব্লাস্ট ও সিট ব্লাস্ট রোগ তেমন হয়নি। চাষিরা ধান কাটা ও মাড়াই শুরু করেছেন। ফলন ভালো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, চলতি মৌসুমে শেষের দিকে অতি খরার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে উৎপাদন খরচ কিছুটা বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সবমিলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা। আমরা আশা করছি ভালো ফলনের সঙ্গে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

তিনি আরও বলেন, এবার সারাদেশের মতো রংপুর অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি হলেও বোরো ও আউশ ধানের ফলন ভালো হবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কর্তন করা হবে। বিভিন্ন জায়গায় আগাম বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন চাষিরা। আশা করছি আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষকরা ভালো ফলন ও ভালো দাম পাবেন।

এদিকে গত ২১ এপ্রিল বোরো মৌসুমের ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এবার বোরো সংগ্রহ ২০২৪ মৌসুমে পাঁচ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, আতপ চাল এক লাখ টন এবং ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা, আতপ চাল ৪৪ টাকা ও গম ৩৪ টাকা। আর ২০২৩ সালে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য ছিল যথাক্রমে ধান ৩০ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৪ টাকা এবং গম ৩৫ টাকা।

এদিকে ধানের দাম নির্ধারণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ জানিয়েছেন, ‘বোরো ধানের উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান। গত বছরের চেয়ে এ বছর ধানের মূল্য কেজিপ্রতি দুই টাকা বাড়ানো হয়েছে।’

কৃষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, বঙ্গবন্ধু ধান১০০, ব্রি ধান১০২, বিনাধান ২৫ প্রভৃতি নতুন জাতগুলোর ফলন আগের পুরোনো জাত ব্রি ধান২৮ ও ২৯-এর তুলনায় অনেক বেশি। এসব জাতের নতুন ধান চাষ করে কৃষকরা অভূতপূর্ব ফলন পেয়েছেন। এলাকাভেদে জাতগুলোর বিঘাপ্রতি গড় ফলন হয়েছে ২৫-৩০ মণ। এগুলোর চাষ বাড়াতে হবে।’