নীলফামারীতে বাড়ছে লাভজনক ফসল বাদামের চাষ। ঝুঁকি কম, ব্যাপক চাহিদা ও বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় গতবারের তুলনায় চলতি মৌসুমে বেড়েছে বাদামের চাষ। স্বল্প খরচে বাদাম চাষ লাভজনক হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এবার নীলফামারীর ছয় উপজেলায় এক হাজার ২০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এযাবৎ লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন সমপরিমাণ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাদামের বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। কৃষক আমন, আলু ও বাদামসহ বছরে তিনটি ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছে।
গত বছর ছয় উপজেলায় বাদাম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক হাজার ১৮ হেক্টর। এবার জেলায় দুই হেক্টর জমিতে বেশি হয়েছে বাদামের চাষ। ভিটামিনসমৃদ্ধ পুষ্টিকর ও মুখরোচক এই বাদাম চাষ দিন দিন বেড়েই চলছে।
জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩৭৭ মেট্রিক টন। বাদাম চাষের জন্য উপযোগী জেলার জলঢাকা, ডোমার ও ডিমলা উপজেলার খালিচা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, বালাপাড়া, তিস্তার চর, বড় রাউতা, জলদান পাড়া, বগুড়ার ডাঙ্গাসহ অনেক এলাকায় বাদাম চাষ হয়েছে।
জেলার ডোমার সোনারায় ইউনিয়নের চিকনমাটি গ্রামের বাদামচাষি রফিকুল ইসলাম (৪২) বলেন, ‘আগে প্রচুর পাটের চাষ করতাম। কিন্তু পাট চাষে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। গত বছর থেকে বাদাম চাষ করি। প্রতি বিঘায় বীজ, সার, হাল নিড়ানী ও পরিবহন বাবদ ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় বাদাম উৎপাদন হয় ১২-১৩ মণ। প্রতিমণ ছয় হাজার ৪০০ টাকা হিসেবে বিঘায় বিক্রি হয় ৮৩ হাজার ২০০ টাকা। এতে লাভ হয় ৬৭ হাজার ২০০ টাকা। বাদাম চাষে খরচ কম লাভ বেশি।
একই গ্রামের বাদামচাষি হরিকেষর রায় (৫৫) বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের তুলনায় বাদাম চাষে তেমন শ্রম দিতে হয় না। এছাড়া অন্যান্য ফসলের তুলনায় বাদামে রোগবালাই কম হওয়ায় কীটনাশক প্রয়োগের ঝামেলা কম। মাঝেমধ্যে দু-একবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করলেই হয়। বাজারে বাদামের ভালো দাম থাকায় কয়েক বছর ধরে বাদাম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন এখানকার চাষিরা।
জেলার জলঢাকা উপজেলার বাদামচাষি সাইদুল হোসেন (৪৬) বলেন, ‘আমি এবার তিন বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছি। এসব জমিতে আগে পাট আবাদ করতাম। কিন্তু পাটের চেয়ে বাদামে লাভ হয় বেশি। পরিবারে খাওয়ার পরেও প্রতি বিঘায় যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এছাড়া বাদাম আমাদের জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়। মহাজনরা বাড়িতে এসে আগাম বায়নাও দিয়ে যায়। বর্তমানে বাদাম চাষে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। আমার লাভ দেখে অন্য কৃষকরাও বাদাম চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
জেলা সদরের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামের কৃষক আনারুল ইসলাম (৪৭) জানান, ‘এ বছর দুই বিঘা জমিতে বাদামের চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২০ কেজি বীজ রোপণ করতে হয়। প্রতি কেজি বীজ ২০০ টাকা হিসেবে চার হাজার টাকার বীজ দিয়ে উৎপাদন হয় বিঘায় ১২-১৪ মণ।
প্রতিমণ বাদাম বাজারে বিক্রি করা যায়, ছয় হাজার ৪০০ টাকা দরে। আর সার, বীজ, হাল, কর্তনসহ জমির শ্রেণিভেদে খরচ হয় বিঘায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এতে একজন কৃষকের প্রতি বিঘায় লাভ হয় ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা। ১২০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। রোগবালাইয়ের ঝামেলা নেই। তাছাড়া ধান ও পাটের বন্যা-খড়ায় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বাজারে নেই ন্যায্য মূল্য। কেন অন্য ফসল করতে যাব। কাজেই বাদাম চাষেই এখন কৃষকের ভরসা।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক আহমেদ বলেন, ‘সদরে ১০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাদামের বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া বাদাম চাষের উপযোগী। বাদাম বাড়তি একটি ফসল। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বারী চীনাবাদাম ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ও বিনা চীনাবাদাম ৪, ৮, ঢাকা ১, ২ সহ ডিজি ১, ২। এছাড়া বাবনচণ্ডি ও ঝিঙ্গা জাতের বাদামের বেশি ফলন হওয়ায় লাভ হয়।’ আশা করি, এবার বাদাম চাষে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। মাঠপর্যায়ে উপসহকারী কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. এসএম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চীনাবাদাম একটি লাভজনক ফসল। তাই কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে উপজেলা কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার জেলায় বাদাম চাষ হয়েছে এক হাজার ২০ হেক্টর। খরচ কম, দাম বেশি, তাই বাদাম একটি লাভজনক ফসল। এলাকায় কম খরচে উচ্চ ফলনশীল চীনাবাদাম উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।’