খামারীদের চিন্তার অন্ত থাকেনা যখন গবাদি পশুর মাঝে মাঝে নানা রোগ ব্যাধি দেখা দেয়।। এমনকি উৎপাদন কমে যায়। এসব বিষয় খামারীদের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা অবশ্যক। তাই আসুন জেনে নেই গবাদি পশুর কতিপয় রোগ ও তার প্রতিকার।
ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয় কারণঃ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার ককসিডিয়া বা আইমেরিয়া নামে এক প্রকার প্রোটোজোয়া কৃমির সংক্রমণের ফলে এই রোগ দেখা যায়।
লক্ষণঃ
– হঠাৎ করে দুর্গন্ধযুক্ত পাতলা পায়খানা হয়।
– ডায়রিয়া সহজে কমতে চায় না।
– কয়েক দিন পর পায়খানার সাথে রক্ত ও মিউকাস দেখা যায় এবং আমাশয়ের মত লক্ষণ দেখা দেয়।
– লেজের গোড়ায় রক্ত মিশ্রিত মল লেগেকে। তীব্র কোথ দেয়ার ফলে অন্ত্র থেকে মল বেরিয়ে আসে এবং রেকটাল প্রলাপস হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
– পশু দুর্বল হয়ে যায়।
– পশুর খাদ্যে অরুচি দেখা যায় এবং শুকিয়ে যায়।
– পশুর শরীরে খিচুঁনি দেখা দেয়।
চিকিৎসাঃ
ক. ডিমিডিন ইনজেকশনঃ প্রথম দিন প্রতি ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২৫ থেকে ৩০ মিলি করে মাংসে বা চামড়ার নীচে বা শিরায় ইনজেকশন দিতে হবে। দ্বিতীয় দিন থেকে উক্ত মাত্রার অর্ধেক হিসেবে পরপর ৩-৫ দিন প্রয়োগ করতে হবে। অথবা
খ. সালকাট্রিম বোলাসঃ প্রতি ৪০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য একটি বোলাস দৈনিক একবার বা দুইটি বিভক্ত মাত্রায় ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে।
প্র্রতিরোধঃ এরোগ বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির রোগ বলে গ্রাম ভিত্তিকভাবে প্রাণীতে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়না। তবে কর্মের ক্ষেত্রে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ক. স্বাস্থ্য সম্মত পালন ব্যবস্থা।
খ. বাচ্চা প্রসবের ঘর বা স্থান পরিস্কার ও শুস্ক থাকা আবশ্যক।
গ. ঠাসাঠাসি ভাবে পালন করা উচিৎ নয়।
ঘ. পশুর সকল খাদ্য ও পানীয় যাতে মলের সাথে লেগে দুষিত না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ. রাসায়নিক প্রতিরোধ- প্রতিরোধ মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ঔষধ খাওয়ালে এরোগ প্রতিরোধ করা যায়।
পোকাপড়া রোগ বা স্ক্রুওয়ার্ম মিয়াসিস কারনঃ প্রধানত কচলিওওমায়া হোমিনিভোরাক্স ও ক্রিসোমায়া বেজিয়ানা দ্বারা পোকাপড়া রোগ বা স্ক্রুওয়ার্ম মিয়াসিস হয়ে থাকে। এটি একটি মাছি ঘটিত রোগ। ‘স্ক্রুওয়ার্ম’ বলা হয়। এসব মাছির লার্ভা ত্বকের ক্ষত আক্রান্ত করে এরোগ সৃষ্টি করে। তাই এরোগকে ক্ষত মিয়াসিস বলে।
লক্ষণঃ
– লার্ভা ক্ষত ছিদ্র করে গর্তের সৃষ্টি করে।
– আক্রান্ত টিস্যুকে ক্রমশঃ নিক্রোসিস (পঁচা) ও রক্ত ক্ষরণ হয়।
– ক্ষতে রক্ত ক্ষরণের কারণে অ্যামোনিয়া ও প্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
– ক্ষত থেকে বাদামী বর্ণের দুর্গন্ধযুক্ত নিঃস্রাব পড়ে যা অন্যান্য প্রজাতির মাছিকে আকৃষ্ট করে।
– এই ক্ষতে অন্যান্য মাছিও ডিম দেয় এবং একই সাথে বহু প্রজাতির মাছির আক্রমণ ঘটে।
-জ্বর, টকসেমিয়া ও ডিহাইড্রেশন দেখা যায়।
-চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় পশু মারা যাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে।
চিকিৎসাঃ
লার্ভানাশক ও জীবাণু নাশক পদার্থ দ্বারা পোকাপড়া ক্ষতের চিকিৎসা করা হয়। প্রথমে ক্ষতস্থান থেকে লার্ভা গুলো চিমটার সাহায্যে তুলে ৭০% অ্যালকোহল যুক্ত বোতলে সংগ্রহ করতে হয়। সমপরিমান তারপিন তেল ও ক্লোলকর্মে গজ চুবিয়ে ক্ষতের একেবারে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে পর দিন গজ টানলে গজের প্রান্তে লার্ভাগুলো দেখা যাবে এবং পরে ক্ষত পরিস্কার করে ডাস্টিং পাউডার দিয়ে ক্ষত ড্রেসিং করতে হবে। এছাড়া ক্রেসল ও তারপিন তেল প্রয়োগে কার্যকর হয়।
– লার্ভানাশক হিসেবে ৫% লিনোডন অথবা ৩% কোয়ামাকোস ব্যবহার কার্যকরী।
– আইভারমেকটিন ০.২ মি.গ্রা./কেজি হিসেবে ত্বকের নীচে একবার ইনজেকশন দিলে ২ দিনের মধ্যে সকল লার্ভা মারা যায় এবং ১৬-২০ দিন প্রতিরোধ করে।
প্রতিরোধঃ
– মাছির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
– দেহে যাতে ক্ষত সৃষ্টি না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– সম্ভব হলে ক্ষতস্থান পলিথিন বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মাছি না পড়ে। যথা সম্ভব ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করতে হবে।
– আইভারমেকটিন ০.২ মি.গ্রা./কেজি হিসেবে খোঁজা করার সময় ত্বকের নীচে ইনজেকশন দিলে ১৬-২০ দিন এরোগ থেকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
– বায়োলজীক্যাল প্রতিরোধ-পিউপাকে কালচার করে কোবাল্ট ৬০ দ্বারা ইরেডিয়েশনের মাধ্যমে পুরুষ মাছিকে বন্ধা করে ছেড়ে দিলে স্ত্রী মাছির সাথে মিলন হয়ে অনুর্বব ডিম সৃষ্টি হয় ফলে মাছির বংশ বিস্তার রক্ষা হয়।
কাধে ঘা কারণঃ
ষ্টেকানোফাইলেরিয়া আসাসেনসিস নামক কৃমিই এরোগের জন্য দায়ী।
– গবাদি পশুর লাঙ্গল পানা বা অন্যান্য ঘর্ষণের ফলে কাধে ছোট ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যেখানে মাছির মাধ্যমে উপরোল্লিখিত কৃমির ডিমের সংক্রমণ ঘটে এবং ধীরে ধীরে বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যেহেতু এটি কৃমি জনিত ঘা তাই এখানে এন্টিবায়োটিক পাউডার বা মলম লাগিয়েও কোন উপকার পাওয়া যায় না।
লক্ষণঃ
– গবাদি পশুর কাধে প্রথমে ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে তা অনেক বড় হয়ে যায়।
– এতে খুব বেশী চুলকানী হয় ফলে পশু যেকোন শক্ত বস্তুুর সাথে কাধ ঘষে।
– ঘর্ষণের ফলে রক্ত বের হয় বা লাল রং এর পানির মত পদার্থ বের হয়।
– ঘায়ের উপরের অংশে কেরোটিন জমে শক্ত হয়ে যায়।
– পশু খুব অস্বস্তি বোধ করে ফলে খাওয়া দাওয়া কমে যায়।
– গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়।
– পশু লাঙ্গল বা গাড়ী টানতে পারে না।
চিকিৎসাঃ
ক. নেগুভোনঃ ৬-২০% ভ্যাসলিনের সাথে মলম তৈরী করে দিনে ২-৩ বার লাগানো যায়। তবে নেগুভোন ও সালকানিলামাইড সমন্বয়ে ভ্যাসলিন দিয়ে তৈরী মলম অধিক কার্যকরী। মলম প্রয়োগের পূর্বে ক্ষতস্থানের বিনষ্টকলা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (১:১০০০০০) সলূশন দিয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে। অত:পর ২-৩ বার করে মোট ১০ দিন প্রয়োগ করলে ১৫ দিনের মধ্যে আরোগ্য লাভ হয়।
এছাড়া নেগুভোন তিসির তেল বা কাষ্টর ওয়েলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
খ. টেট্রামিজল হাইড্রোক্লোরাইড (৭.৫%) মলম ৩-৪ দিন প্রয়োগে ১০০% পশু ভাল হয়।
গ. আইভারমেকিটনঃ প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২০০ মাইক্রোগ্রাম হিসেবে ২৮ দিনের ব্যবধানে ত্বকের নীচে মোট দুটি ইনজেকশন বেশ কার্যকর। যেমন- ভার্মিক ইনজেকশন- ০.২ মি.গ্রা. প্রতি কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে অর্থাৎ ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ মি.লি. হিসেবে চামড়ার নীচে ইনজেকশন দিতে হবে এবং ২৮ দিন পর পুনরায় দিতে হবে।
প্রতিরোধঃ
– ক্ষতস্থানে যাতে কোন মাছি না বসে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ উদ্দেশ্যে ক্ষতস্থান পলিথিন বা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া উত্তম।
– কীটনাশক পদার্থ বা মাছি তাড়ানোর ঔষধ ব্যবহার করা ভাল। এক্ষেত্রে তারপিন তেল ক্ষতে প্রয়োগ করা হয়।
– ক্ষতের সুষ্ট চিকিৎসার মাধ্যমে কৃমি ধ্বংস করে রোগের উৎস বন্ধ করতে হবে।
উকুন, আঠালী ও মাইট আক্রমণ কারনঃ উকুন, আঠালী ও মাইট বহি:পরজীবী। বিভিন্ন ধরণের উকুন, আঠালী ও মাইট দ্বারা পশু আক্রমণ হতে পারে। এরা পশুর শরীরের উপরিভাগে অর্থাৎ চামড়ায় বসবাস করে এবং শরীর থেকে রক্ত চুষে বেঁচে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন ধরণের রোগ এক পশু থেকে অন্য পশুতে ছড়িয়ে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা রক্ত চুষে নিয়ে পশুর শরীরের রক্ত স্বল্পতা সৃষ্টি করে।
লক্ষণঃ
– পশুর লোম উসকু খুসকু হয়ে যায় এবং অনেক সময় লোম ঝরে যায়।
– পশুর ঘাড়ে চুলকানী হয় এবং শক্ত বস্তুর সাথে শরীর ঘষার ফলে অনেক সময় চামড়া উঠে যায়।
– পশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় এবং দুধ উৎপাদন কমে যায়।
– রক্ত স্বল্পতা দেখা যায়।
– আঠালী এনাপ্লামোসিস ও বেবিসেয়োসিস নামক রোগের জীবাণু বহন করে বলে এসব রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চিকিৎসাঃ উকুন, আঠালী ও মাইট আক্রমণ হলে নিম্নের ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে-
– ভার্মিক ইনজেকশন (আইভারমেকটিন)ঃ ০.২ মি.লি.গ্রাম/কেজি দৈহিক ওজন হিসেবে অর্থাৎ প্রতি ৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ মি.লি. হিসেবে চামড়ার নীচে প্রয়োগ করতে হবে।
– নেগোসাইট পাউডার (নেগোডন পাউডার)ঃ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে পশুর শরীরে ¯েপ্র করতে হবে অথবা পানিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে সমস্ত শরীরে লাগিয়ে দিতে হবে। ২১ দিন পর এভাবে পুনরায় প্রয়োগ করতে হবে। হালকা গরম পানিতে নেগোসাইট পাউডার মিশালে ভাল ভাবে মিশে যায় এবং ভাল ফল পাওয়া যায়।
সতর্কতাঃ
– লেগুডন পাউডার প্রয়োগের পূর্বে ও কিছু পর পর্যন্ত পশুকে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে হবে এবং পশুর মুখে অবশ্যই ঠুসি পরিয়ে রাখতে হবে।
– ঔষধ ব্যবহারের দুই ঘন্টা পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর ভাল ভাবে ধুয়ে দিতে হবে।
প্রতিরোধঃ
উকুন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য- ক. পশুর উকুনের চিকিৎসায় লিন্ডেন ০.০৫%, ম্যালাথিওন ০.৫% ও টক্সেফেন ০.৫% পশুর শরীওে ¯েপ্র বা ব্রাশের সাহায্যে ব্যবহার করা যায়।
খ. কতিপয় কীটনাশক পদার্থ সাইপারমেথ্রিন-১০০০ পি.পি.এম ¯েপ্র হিসেবে উকুনের বিরুদ্ধে কার্যকর।
আঠালী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য-
ক. কীটনাশক পদার্থ প্রয়োগ যথা-কোয়ামাফস-০.১-০.১৫% প্রয়োগ করে ১০০% কার্যকর এবং ডায়াজিনোন- ০.০২৫-০.২০% ¯েপ্র করতে হয়।
খ. চারণভূমি ব্যবস্থাপনা।
গ. রেজিস্ট্যান্ট পশু সৃষ্টি।
মাইটের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য-
ক. বেনজিন হেক্সাক্লোরাইড (০.০১৬%) ডায়াজিনোন (০.০১%) ও প্রোপেটামফোস (০.০১২৫%) মোষ একবার ডিপিংয়ে কার্যকর এবং প্রায় ৪ সপ্তাহ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
খ. ট্রাইক্লোরফেন- ০.৫-১.৫% আক্রান্ত মহিষের শরীর প্রত্যহ ধৌত করলে ৫ দিনে আরোগ্য লাভ করে।
গ. টক্সোফেন (০.৫%) গরুতে একবার ডিপিং পদ্ধতিতে প্রয়োগে মাইটের বিরুদ্ধে ভাল কার্যকর ফল পাওয়া যায়।