ড্রাগনের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ঝিনাইদহে মড়ক লেগে উজাড় হচ্ছে ড্রাগন ক্ষেত। কোনোভাবেই রোগ নিয়ন্ত্রনে আনা যাচ্ছে না। নামী দামী কোম্পানীর ছত্রাক নাশক, মাকড় নাশক, ব্যাকটেরিয়া নাশক ব্যবহার করেও প্রতিকার না পাওয়ায় বেশ কয়েকজন ড্রাগন চাষী ড্রাগন গাছ কেটে ফেলছেন। মড়ক আতংকে ঘুমের মধ্যেও আঁৎকে উঠছেন অন্য চাষীরা।
ঝিনাইদহ জেলায় প্রায় ২হাজার হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হচ্ছে। জেলাব্যাপী প্রায় ৫/৬হাজার চাষী ড্রাগন চাষ করেন এবং এ চাষের সাথে প্রায় ২৫/৩০ হাজার লোক জড়িত আছেন। চাষীদের দেয়া তথ্য মতে প্রায় এক পঞ্চমাংশ জমির ড্রাগন গাছ মারাত্মক এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং রোগ নিরাময় করতে না পেরে কমপক্ষে ৫০বিঘা জমির ড্রাগন গাছ ইতোমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে।
জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের ড্রাগন চাষী শামীম উদ্দীন জানান, প্রায় ৩ মাস আগে তার বাগানে মড়ক লাগে। মাত্র দুই-তিন দিনের ব্যবধানে দুই বিঘা জমির সব গাছ আক্রান্ত হয়ে যায়। অভিজ্ঞ চাষীদের পরামর্শে বিভিন্ন কোম্পানীর ছত্রাক নাশক, মাকড় নাশক, ব্যাকটেরিয়া নাশক ব্যবহার করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। তবে কলিচুন ব্যবহারে রোগ নিয়ন্ত্রনে আসছে বলে তিনি মনে করছেন। শামীম জানান, তিনি আধা কেজি কলিচুন ১৬ লিটারের ৪ ঢমে পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করেছেন সপ্তাহে দুই বার। এতে ফল পাচ্ছেন বলে তিনি জানান।
একই উপজেলার একই এলাকার ড্রাগন চাষী কুতুব উদ্দিন জানান, তিনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক সব ধরনের ছত্রাক নাশক, কিটনাশক, ব্যাকটেরিয়া নাশক ও মাকড় নাশক ব্যবহার করেও প্রতিকার পাননি। তাই প্রায় ২বিঘা জমির ড্রাগন কেটে ফেলেছেন। একই উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আমিরুল ইসলাম ১৫ কাঠা জমির গাছ কেটে ফেলেছেন।
ঝিনাইদহের সদর উপজেলার পাগলা কানাই ইউনিয়নের বানিয়া কান্দর গ্রামের ড্রাগন চাষী ইউসুপ হোসেনের আড়াই বিঘা জমির ড্রাগনে মড়ক লেগেছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে গাছগুলো রোগাগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করলেও প্রতিকার মেলেনি। একই এলাকার ড্রাগন চাষী আকাশের দেড় বিঘা জমির ড্রাগনে একই রোগ হয়েছে। নানা ধরনের ঔষধ ব্যবহার করে তিনিও কোনো প্রতিকার পাননি।
তাদের এলাকার আরও ৫/৭ জনের প্রায় ১৪/১৫ বিঘা জমির ড্রাগন গাছ একই রোগে আক্রান্ত বলে তারা জানান।
মহেশপুর উপজেলার গোরিনাথ পুর গ্রামের মশিয়ার রহমানে ১৫ বিঘা জমি একই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া একই উপজেলার হাসান, জাহিদুল, মহাসিনসহ বেশ কয়েকজন ড্রাগন চাষীর প্রায় ২’শ বিঘা জমির ড্রাগন গাছ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কোনোভাবেই এই রোগ নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছেন না।
কোটচাঁদপুর উপজেলার নারায়ন বাড়িয়া গ্রামের রেজাউল বিশ^াসের ৩ বিঘা জমির ড্রাগন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তিনি তার বাগান কাটা শুরু করেছেন। একই উপজেলার পাভেল বিশ^াস ২ বিঘা জমির ড্রাগন, মিলন ১৫ কাটা, সুমন বিশ^াস ২ বিঘা, নজরুল ইসলাম ২ বিঘা জমির ড্রাগন কেটে ফেলেছেন। উপজেলার আরও অনেক চাষী দ্রুতই আক্রান্ত ড্রাগন গাছ কেটে ফেলবেন বলে জানা গেছে।
ক্ষতিগ্রস্থ চাষীদের অধিকাংশের অভিযোগ এ ব্যাপারে কৃষি অফিসের কার্যকর কোন পরামর্শ পাচ্ছেন না। তাই নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন চাষীর পরামর্শে হাজার হাজার টাকার ঔষধ প্রয়োগ করে আর্থিকভাবে মারত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং বাধ্য হয়ে তারা গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে কথা হয় ঝিনাইদহ ড্রাগন চাষী কল্যান সমিতির সেক্রেটারী আহসানুল ইসলাম ডনের সাথে। তিনি জানান এরকম সমস্যায় গত বছর তিনিও পড়েছিলেন। তিনি যা প্রয়োগ করে উপকৃত হয়েছিলেন তা তুলে ধরেন- ১.প্রথম দিন ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাক নাশকের সাথে যেকোনো ভালো কোম্পানির মাকড় নাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করেন।
২. এর চার দিন পর প্রপিনেব ৭০% ডাব্লিউপি, স্পর্শক্রিয়া সস্পন্ন ও স্থায়ীভাবে অনুপ্রবেশযোগ্য ডাইথিওকার্বামের জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। ৩. এর চার দিন পর রোভলাল ৫০ঢ়ি ব্যবহার করতে হবে ৪. এর ৫ দিন পর রিডোমিল ছত্রাকনাশক ও ভালো কোম্পানির মাকড় নাশক ব্যবহার করতে হবে ৫. ৫ দিন পর কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। ৫. ৫ দিন পর ম্যানকোজেব ও কার্বান্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। ৬. ৫ দিন পর ব্যবহার করতে হবে। পরবর্তীতে আরও এক বার এভাবে প্রয়োগ করতে হবে বলে তিনি জানান।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনির সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নতুন এ রোগ গত বছর থেকে ড্রাগনে ছড়িয়েছে। আমরা বাগান পরিদর্শন করে পরামর্শ দিচ্ছি। এতে ভালো কাজ হচ্ছে। তাই চাষীদের গাছ না কাটার অনুরোধ করেছেন তিনি।
এব্যাপারে ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় জানান, ড্রাগনের গাছ কেটে ফেলা হ্েচ্ছ এমন তথ্য আমার কাছে নেই। বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ নতুন। বর্তমানে গাছে নতুন নতুন রোগবালাই হচ্ছে। আমরা সাধ্যমতো চাষীদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।