রাজশাহীতে বেড়েছে নাসিক ৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষ

46

রাজশাহীতে বর্তমানে কৃষকদের মধ্যে ভারতের নাসিক অঞ্চলের জনপ্রিয় জাত নাসিক-৫৩ পেঁয়াজ চাষের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। উচ্চফলনশীল, দীর্ঘ সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং বৃষ্টিপাত ও শুষ্ক জলবায়ুর সঙ্গে সহনশীলতার জন্য এই জাতটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ বছরও এই অঞ্চলে ভারতীয় জাতের নাসিক-৫৩ পেঁয়াজ চাষ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
চাষিরা বলছেন, নতুন পদ্ধতির এই পেঁয়াজ চাষ থেকে ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। মাঠে মাঠে ইতোমধ্যে পেঁয়াজের চারা দেখা দিতে শুরু করেছে, চারা দেখে আশায় বুক বাঁধছেন তারা।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজের জোগান নিশ্চিত করতে এই জাতের চাষ একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প। রাজশাহী অঞ্চলে কৃষকেরা নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষে লাভজনক হিসেবে আশা করছেন, যা স্থানীয় অর্থনীতি এবং পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হতে পারে। তারা বলছেন, এবার এই এলাকায় প্রথমবারের মতো নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত না হলে বড় কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না। বিএডিসি থেকে পাওয়া এই বীজ কৃষি বিভাগ চাষিদের মাঝে বিতরণ করেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে মাঠজুড়ে পেঁয়াজের চারা রোপণে চাষিদের দম ফেলার সময় নেই। সারিবদ্ধভাবে পেঁয়াজ রোপণ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। মাঠে- মাঠে সবাই দল বেঁধে লাইন করে সকাল থেকে বিকাল অব্দি। সবাই একসঙ্গে পেঁয়াজের জমিতে বসে পেঁয়াজের চারা রোপণ করছেন। এবার পেঁয়াজের দাম ভালো হওয়ায় জেলাজুড়ে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য সব ফসলের পাশাপাশি পেঁয়াজ চাষের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন চাষিরা।

তানোর উপজেলার চাষি বারিউল ইসলাম জানান, প্রথমবারের মতো তিনি ছয় বিঘা জমিতে নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষ করেছেন। উপজেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ বিভাগের বিনামূল্যে সরবরাহকৃত বীজ থেকে চারা তৈরি করে গত ১৪ আগস্ট জমিতে রোপণ করেন। তিনি বলেন, এই পেঁয়াজ চাষের জন্য কিছুটা উঁচু জমি এবং বেলে, দোআঁশ মাটি প্রয়োজন। সেচের ব্যবস্থাও রাখতে হয়। জমিতে এক ট্রাক নদীর মাটি এবং এক ট্রলি করে জৈবসার প্রয়োগ করেছি। এখন পর্যন্ত রোগবালাই দেখা যায়নি। আশা করছি, নভেম্বরের শেষের দিকে পেঁয়াজ তোলা শুরু করতে পারব।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বিঘায় প্রায় ১২০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হবে। যদিও ৮০ মণ পেঁয়াজ পেলেও লাভ হবে প্রায় এক লাখ টাকা। প্রতি বিঘায় খরচ পড়বে ৬০ হাজার টাকা। এমনকি বাজারে মণপ্রতি দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হলেও ভালো লাভ হবে।
গোদাগাড়ী উপজেলার চাষি মো. আব্দুল করিম জানান, নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষে আমি গত বছর থেকে শুরু করেছি। এ জাতের পেঁয়াজের চারা মজবুত এবং ফলনও ভালো হচ্ছে। এছাড়া এ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা সহজ এবং ভালো দামও পাচ্ছি, যা আমার পরিবারের আয়ের সহায়ক। বাঘা উপজেলার আরেক চাষি হুমায়ুন কবির বলেন, এখানে দীর্ঘদিন ধরে পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে, তবে নাসিক-৫৩ জাতের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এই জাতের পেঁয়াজ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, ফলে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের হিসাবে, ২০২০-২১ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাত্র ২০০ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে এই পেঁয়াজ চাষ হয়েছিল। এরপর ২০২১-২২ এর খরিপ-১ মৌসুমে চাষ হয় ৫০০ বিঘা। আর খরিপ-২ মৌসুমে চাষ হয় ৫ হাজার ২০০ বিঘা।

২০২৩-২৪ এর খরিপ-১ মৌসুমে ৫ হাজার ২০০ ও খরিপ-২ মৌসুমে ৬ হাজার ২০০ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ হয়। এবার ২০২৪-২৫ এর খরিপ-১ মৌসুমে চাষাবাদ আড়াই গুণ বেড়ে ১৩ হাজার বিঘা জমি হয়েছে। হেক্টরপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টন পেঁয়াজের উৎপাদনের আশা করছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে আগে শুধু শীতকালেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ হতো। ২০২০-২১ মৌসুম থেকে শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ। নাসিক-৫৩ জাতের ভারতীয় এ পেঁয়াজের বীজ আমদানি করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ওই পেঁয়াজ প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যেই চাষিদের সরবরাহ করা হয়। এই বীজ থেকে চারা করে পেঁয়াজ চাষে ভালো লাভ করছেন চাষিরা। তাই বাড়ছে চাষাবাদ।

রাজশাহী বিএডিসির উপপরিচালক কে এম গোলাম সরওয়ার বলেন, ভারতে প্রচুর পরিমাণে নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, যা আমাদের দেশে ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বীজ বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এই পেঁয়াজের বীজ আমদানি করা হচ্ছে এবং প্রণোদনা হিসেবে চাষিদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। চাষিরা ভালো লাভ পাচ্ছেন বলে এই জাতের পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, আগে দেশে শুধু শীতকালীন মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষ হতো। কিন্তু এখন গ্রীষ্মকালেও নাসিক-৫৩ জাতের পেঁয়াজ চাষ শুরু হয়েছে। এতে পেঁয়াজ উৎপাদন অনেক বেড়েছে এবং অসময়ের কারণে ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। চাষিরাও এই চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। চাষের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।