যেভাবে দেশি মুরগি পালন করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়

9

দেশি মুরগি মূলত দুইভাবে পালন করা যায়। একটি হলো সম্পূর্ণ ছাড়া অবস্থায়। একে ইংরেজিতে বলে স্ক্যাভেঞ্জিং (Scavenging) আরেকটি হলো আধা ছাড়া- আধা বদ্ধ অবস্থায়। এই প্রক্রিয়াটির ইংরেজি নাম হলো সেমি-স্ক্যাভেঞ্জিং (Semi-Scavenging)। এই দুটি প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়।

১) সনাতন পদ্ধতি।

২) উন্নত পদ্ধতি।

প্রথমে আমরা সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন নিয়ে আলোচনা করবো।

সনাতন পদ্ধতি
সনাতন পদ্ধতি হলো আদি ও অকৃত্রিম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগির জন্য শুধু ঘর বানিয়ে দিলেই হয়। নিয়ম করে ভোরবেলা ঘরের দরজা খুলে দিলে ও সন্ধ্যার পরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া এতে খুব একটা দায়িত্ব নেই। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলোঃ

বাসস্থানঃ
সনাতন পদ্ধতিতে বাসস্থানের কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই কাঠ, সিমেন্ট অথবা বাঁশ দিয়ে ছোট ঘর বানিয়ে দেওয়া হয় যেখানে হাঁস-মুরগি একত্রে বসবাস করে। অনেক গৃহস্থ আবার শলার তৈরি খোপেও মুরগি রাখেন। এ পদ্ধতিতে মুরগির বাসস্থানে আলো বাতাস ঢোকে না ও বাসস্থান স্যাঁতসেতে ও নোংরা থাকে। এমন বাসস্থান লালন-পালনের জন্য আদর্শ নয়। আবার অনেক খামারি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে আরেকটু ভালো ঘর বানান। সেক্ষেত্রে ঘরের মাপ হতে পারেঃ

লম্বাঃ ৫ফুট

প্রস্থঃ ৪ দুট

উচ্চতাঃ ৩.৫ ফুট

খাদ্যঃ
সনাতন পদ্ধতিতে খাদ্য অনেকটাই অসুষম। এ পদ্ধতিতে গ্রামের অনেক পালনকারী ঘরের পড়ে থাকা এঁটো ভাত-তরকারি, সবজি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। কেউ কেউ ধান গম ইত্যাদি দিয়ে থাকে। মুরগি সকাল বেলা সেসব খাবার খেয়ে বাকি সারাদিন খুটে খুটে অন্যান্য খাবার খুঁজে খায়। এসব খাবারের মধ্যে পোকামাকড় অন্যতম। সম্পূর্ণ সনাতন প্রক্রিয়াতে মুরগির পুষ্টি চাহিদা অনেক সময়ই মিটে না। তাই খোলা পদ্ধতিতে পালন করলেও খাবারের জন্য মুরগিদের পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর না করে কিছু সুষম খাদ্য সরবরাহ করা উচিত।

স্বাস্থ্যঃ
সনাতন পদ্ধতিতে পালিত মুরগি সম্পূর্ণ খোলা পরিবেশে বড় হয় বলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হয়। আবার একইসাথে এদের রোগের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও বনে বাদাড়ে ঘুরে বিভিন্ন প্রাণী যেমনঃ কুকুর, বিড়াল, গুইসাপ, চিল ইত্যাদির আক্রমণে অনেক বাচ্চা এমনকি বড় মুরগিরও মৃত্যু হয়। সম্পূর্ণ খোলা পদ্ধতিতে পালিত মুরগিগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হয় না বলে এসব আক্রমণ রোধেরও তেমন কোনো উপায় থাকে না।

সনাতন পদ্ধতিতে পালনের সুবিধাসমূহ
সনাতন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় যেই সুবিধাটি তা হলো এর দারুণ কম ব্যয়। এই পদ্ধতিতে মুরগি পালন করতে চাইলে একদমই স্বল্প পুঁজি নিয়ে তা করা সম্ভব। যেহেতু খাবারের জন্য মুরগিগুলো অনেকটা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল তাই খরচ প্রায় হয়না বললেই চলে। একইসাথে মুরগিগুলো নিজেরাই চরে খায় বলে এদের খুব বেশি পরিচর্যার দরকার হয় না। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে শুধু ব্যয় কম তা নয়। পরিশ্রমও কম।

সনাতন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ
সনাতন পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে তো ধারণা পেয়েছেন। এবার এর অসুবিধা সম্পর্কে জানা যাক। এই পদ্ধতির মূল কথা হলোঃ “কম ব্যয়, কম আয়”।

১) এই পদ্ধতিতে লাভ খুব একটা বেশি হয় না।

২) মুরগিগুলো সুষম খাদ্যের অভাবে প্রায়ই অপুষ্টিতে ভোগে। ফলে মাংস কম হয় এবং ডিম দিতে দেরি হয়।

৩) ছোট বাচ্চাকে খুদ, কুড়ে ইত্যাদি শক্ত খাবার খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব শক্ত খাবার তাদের খেতে অসুবিধা হয় বলে অনেক বাচ্চা অপুষ্টিতে ভোগে। এমনকি মারাও যায়।

৪) গ্রামে গ্রামে একটি প্রচলিত ধারণা হলো উম বা তা দেওয়ার সময় মুরগি খাদ্য গ্রহণ করে না। বাস্তবে এর বিপরীত। তা দেওয়ার সময় মুরগির পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান না থাকলে পরবর্তীতে ডিম দিতে অনেক দেরি হয়।

৫) মা ও বাচ্চা মুরগিকে বেশি সময় একসাথে রাখা হয় বলে পরবর্তীতে ডিম পাড়তে অনেক সময় নেয়।

৬) আশেপাশের পরিবেশে চরে খাওয়ার সময় অন্যান্য পশুর আক্রমণে অনেক বাচ্চা মুরগি মারা যায়।

উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন
আধা আবদ্ধ-আধা ছাড়া পদ্ধতিকেই উন্নত পদ্ধতি বলে। সনাতন পদ্ধতির সাথে এর মৌলিক পার্থক্য হলো দেশি মুরগির বাসস্থান, খাবার ও খরচের দিক দিয়ে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবেই উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন সনাতন পদ্ধতির চেয়ে আলাদা। এ পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করতে হলে খরচ তুলনামূলক বেশিই পড়বে। কিন্তু একইসাথে মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়বে কয়েকগুণ। ফলে লাভও হবে অনেক। অর্থাৎ আপনি যদি বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন করতে চান তবে উন্নত পদ্ধতিতেই পালন করা শ্রেয়।

উন্নত পদ্ধতিতে পালনের কারণসমূহ
আগেই বলেছি উন্নত পদ্ধতির সাথে সনাতন পদ্ধতির পার্থক্য মূলত বাসস্থান, খাবার ও খরচের মধ্যে। কিন্তু আরো একটি দিক রয়েছে যা বিপুল পার্থক্য গড়ে দেয়। তা হলো মুরগির উৎপাদনচক্র। সনাতন পদ্ধতিতে একটি উৎপাদনচক্র সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে ১৩৫-১৫০ দিন। যা অত্যধিক বেশি। নিয়ম মেনে উন্নতভাবে দেশি মুরগি পালন করলে তা ৫০-৬০ দিনেই নামিয়ে আনা সম্ভব। ফলে বছরে তিনটি উৎপাদন চক্রের বদলে ছয়টি উৎপাদনচক্র করা সম্ভব। যা ডিম ও মাংসের পরিমাণকে করে তুলবে প্রায় দ্বিগুণ। ঠিক এ কারণেই এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য আদর্শ। আবার এতে পরিশ্রম খুব বেশি তেমনও নয়। এককালীন একটি আদর্শ ঘর বানিয়ে নিলে এরপর থেকে দৈনিক ১-২ ঘন্টা কাজের মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই মুরগি পালনের পুরো প্রক্রিয়াটি বজায় রাখতে পারবেন।

তাহলে চলুন জানা যাক কিভাবে করবেন উন্নত পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন।

বাসস্থানঃ
উন্নত পদ্ধতিতে বাসস্থান নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। সাধারণত হাস মুরগির খোপগুলো বদ্ধ ও স্যাঁতসেতে হয়। কিন্তু উন্নত পদ্ধতিতে সেরকম হলে মোটেও চলবে না। প্রথমেই আসা যাক খোপ নির্মাণের জন্য কী কী ব্যবহার করবেন তার ব্যাপারে। সাধারণ বাঁশ-কাঠ, তাল, নারিকেল অথবা সুপারি পাতা এসব ব্যবহার করেই ঘর নির্মাণ করতে পারবেন। খেয়াল রাখবেন ঘরটি যেনো নিরাপদ ও উঁচু স্থানে হয়। খোপের আশেপাশের দেয়াল দিয়ে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসার ব্যবস্থা করুন। ঘরটির সাধারণ বৈশিষ্ট্যঃ

দৈর্ঘ্যঃ ৬ ফুট

প্রস্থঃ ৪ ফুট

উচ্চতাঃ সাড়ে ৩ ফুট

খোপটিতে মোট তিনটি স্তর বা তলা থাকবে। ঘর হবে মোট ৮ টি। প্রথম তলায় থাকবে বড় বড় দুটি ঘর। একটি দুই ফুট চওড়া অপরটি চার ফুট চওড়া। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় সমান আকারের তিনটি করে মোট ছয়টি ঘর থাকবে। প্রত্যেকটি ঘর এক ফুট উঁচু ও দুই ফুট চওড়া হবে। প্রত্যেকটি ঘরেই দরজা থাকবে ও দরজায় তালা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি খোপে অবশ্যই খাবার ও পানির আলাদা আলাদা পাত্র স্থাপন করতে হবে। একইসাথে প্রত্যেকটি ঘরের মেঝে শুকনো লিটার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে মুরগির বিষ্ঠা মেঝেতে লেপটে না যায়। কিছুদিন পর পর লিটার শক্ত হয়ে গেলে সেগুলো পরিষ্কার করে নতুন লিটার দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার থেকে কিনে লিটার ব্যবহার করতে পারেন। আবার কাঠের গুঁড়া বা তুষ জোগাড় করতে পারলে তা দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও শীতকালে যেনো মুরগির ঠান্ডা না লাগে তাই পুরো খোপ ঢেকে দেওয়ার মতো চটের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

খোপ ব্যবস্থাপনাঃ
উন্নত পদ্ধতিতে যেহেতু একটি খোপে মোট ৮টি ঘর বানানো হয় তাই ঘরগুলোর কার্যকারীতা সম্পর্কেও জেনে নেওয়া উচিত।

প্রথম তলাঃ- প্রথম তলার সবচেয়ে বড় ঘরটি হলো প্রাপ্তবয়স্ক মুরগির ঝাঁক রাখার জন্য। প্রথম তলার ছোট ঘরটি হলো ডিমে তা দেওয়ার ঘর। মুরগির ডিমে তা দেওয়ার জন্য নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন। তাই এই ঘরে তা দেওয়ার আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয় তলাঃ- তৃতীয় তলার সর্ব বাম অথবা সর্ব ডানের ঘরটি হলো ডিম ফোটার পর ৩০ দিন বয়সী বাচ্চা রাখার জন্য। বাচ্চার সংখ্যা বেশি হলে ধীরে ধীরে বাকি ঘরগুলো পূরণ হবে।

দ্বিতীয় তলাঃ- দ্বিতীয় তলার ঘরগুলো হলো ৩০ দিন থেকে ৭০ দিন বা তার বেশি বয়সী মুরগি রাখার জন্য।

মুরগির সংখ্যাঃ
উন্নত পদ্ধতিতে একটি খোপে ১০-১২ টি মুরগির ঝাঁক রাখুন। প্রথমেই ১০-১২ টি মুরগি জোগাড় করতে না পারলে এর কমেও শুরু করতে পারেন। তবে এক ঘরে ১৫-১৬টির বেশি মুরগি রাখবেন না। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আরো বড় ঘর বানিয়ে নিন অথবা বেশি সংখ্যক ঘর বানান। প্রতি ১০-১২টি দেশি মুরগির জন্য ১-২টি মোরগ রাখবেন। এক্ষেত্রে ভালো জাতের মোরগ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৪০০-৬০০ গ্রাম ওজনের মোরগ দিয়ে শুরু করা যায়।

খাবারের পরিমাণঃ
উন্নত পদ্ধতিতে পালন করতে হলে অবশ্যই সুষম খাবারের নিশ্চয়তা থাকা চাই। চাইলে এ খাবার বাজারে কিনতে পাওয়া যাবে। আবার গম, গমের ভুষি, ভুট্টা, খুদ, কুড়া, শুটকি গুঁড়া, ঝিনুক বা শামুকের গুঁড়া, হাড় সিদ্ধ গুঁড়া, খৈল, কচি ও সবুজ শাকসবজি মিলিয়ে নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন সুষম খাদ্য।