(বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে)
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ: বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত রবি ঠাকুর মূলত কবি, ছোট গল্পকার, উপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত। তার আরেকটি পরিচয়, তিনি একজন কৃষক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার পুত্র ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিদারিত্ব চালিয়েছেন। গ্রামে গঞ্জে, মাঠে ময়দানে জমিদারিত্ব চালাতে গিয়ে নিজেও কৃষিকাজের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। গ্রামীণ মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা উন্নয়নকল্পে রবি ঠাকুর কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চিন্তা ও কর্মের সমন্বয়ে সনাতন কৃষি ব্যবস্থাপনায় এনেছেন আধুনিকতা, বিজ্ঞান, শক্তি ও যান্ত্রিকতায় অপরুপ সমন্বয়।
কৃষকদের প্রতি রবি ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি:
রবি ঠাকুর জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদারী কর্মকান্ড তদারকি করতে প্রায়ই গ্রামে গঞ্জে গিয়েছেন। মনের মাধুরি মিশিয়ে মিশেছেন গ্রামীণ মানুষের তথা প্রজাদের সাথে। প্রজাদের অধিকাংশই ছিল কৃষক, কৃষিজীবী বা কৃষিনির্ভর। তাই কৃষকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন। একান্তে সময় কাটানো, সান্নিধ্য আসার ফলে সঞ্চয় করেছিলেন বিশাল অভিজ্ঞতা। গ্রামীণ পরিবেশ, কৃষক প্রজাদের প্রসঙ্গেই তিনি উচ্চারিত করেছেন, ‘‘আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লী গ্রামের সাথে আমার নিকট পরিচয় হয়েছে। তখন চাষিদের সাথে আমার প্রত্যহ ছিলো দেখাশোনা। ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে আছে সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পৌঁছায়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়”। তবুও অতি সাধারণ থেকেও তারা অসাধারণ। জমিদারি প্রথা মানেই কৃষকের উপর নির্যাতন। তিনিও তাই দেখেছেন। কৃষক প্রজার দুঃখ, দুর্দশা, সনাতন কৃষি ব্যবস্থা সামাজিক শোষণ অনাচার রবি ঠাকুর নিজেই উপলব্দি করেছেন। ‘রক্ত করবী’ নাটকে প্রতীকের ছলে ধণী শ্রেণির সংগে চিরন্তন দ্বন্দময়তা ও কৃষিজীবী কৃষ্টির ভবিষ্যতের আভাস সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। জমিদারি রক্তের ধারা নিস্তেজ করে, সুনিপুণ মমতায় পাশে দাঁড়িয়েছেন অবহেলিত কৃষক প্রজার। তখনকার কৃষকরা ছিল নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, নিরন্ন, অত্যাচারিত, বঞ্চিত, লাঞ্চিত। প্রজাদের কষ্ট কবির মনের দেয়ালে বার বার আন্দোলিত করেছে। তাই তিনি বলেছেন “আমার জন্মগত পেশা জমিদারী, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারী। এ কারণেই জমিদারীর জমি আকড়ে থাকতে আমার প্রবৃত্তি নেই। এ জিনিসটার পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। জমিদারী ব্যবসায় আমার লজ্জা বোধ হয়। আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে নিচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলে বেলা থেকে পরজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি”। পল্লী গ্রামের জনজীবনের অন্তহীন উপাদান এবং ভূমিহীন কৃষকের জীবনের করুণ শৈল্পিক চিত্র ‘শাস্তি’ ‘দুর্বুদ্ধি’ ও ‘সমস্যাপূরণ’ গল্পে তুলে ধরেছেন। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের সময় কৃষকরা ছিল নিতান্ত গরিব। ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ছিল গতানুগতিক। ফলে ফসল উৎপাদন কম হতো। খাজনা পরিশোধ করার মতো অবস্থা হতো না। ফলে সব সময়ই অত্যাচারে নির্যাতিত হতো। প্রতি নিয়ত এসব নির্মমতা রবি ঠাকুর স্বচক্ষে উপলব্দি করতে পেরেছেন। কবি গুরু বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানের প্রতিটি রহস্যই যেন একটি বীজ। বীজের অভ্যন্তরে যেমন সুপ্ত চারা বা সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। কৃষক মাটির বুক চিরে সেই বীজ রোপন করে। সুনিবিড় পরিচর্যা, পরম মমতা আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে একটি নতুন চারা গজায়। অতঃপর ফুলে ফলে ভরে তুলে। সৃষ্টি হয় সুনির্মল ধরণী। আর যদি কাজ না করে তা হবে নিরর্থক। রহস্য আজীবন রহস্যই থেকে যাবে। তাই তিনি দৃপ্তকন্ঠে বলেছেন, “আমাদের দেশের চাষের জমির ওপর সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের আলো ফেলিবার দিন আসিয়াছে। আজ শুধু একলা চাষির চাষ করিবার দিন নাই। আমাদের তাহার সাথে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে। আজ লাঙ্গলের ফলার সাথে আমাদের মাটির সংযোগ যথেষ্ট নয়। সমস্ত দেশের বুদ্ধির সংগে, অধ্যবসায়ের সাথে তাহার সংযোগ হওয়া চাই”
কৃষি ও কৃষিজীবীদের রবি ঠাকুরের প্রতি অবদান:
শিলাইদহে সর্বপ্রথম তিনি উন্নত জাতের ভুট্টা, ধান ও অন্যান্য ফসলের আবাদ প্রচলন করে। শাহাজাদপুরে তার কর্মকান্ডের স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে। বিখ্যাত গল্প ‘পোষ্ট মাস্টার’ খ্যাত শাহাজাদপুর কুঠি বাড়ি অনতিদূরে পোতাজিয়ার ঘোষেরা দুগ্ধজাত দ্রবাদি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কবি তাদের উন্নত প্রজাতীর গাভী ও চারন ভূমি দান করেন। লাল রংঙের এই গাভী ১৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয় যা ‘পাবনা ব্রিড’ নামে সারা দেশে সমাদৃত। প্রকৃতির সন্তান রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বৃক্ষপ্রেমিক। বৃক্ষ সম্পর্কে কবিতা রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বনবানী’,‘বৃক্ষ বন্দনা’ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। দৃপ্ত কন্ঠে উদাত্ত আহবান করেছেন, “দাও ফিওে সে অরণ্য, লও এ নগর”। তিনি নিজে বৃক্ষ রোপণ করেছেন। বৃক্ষ রোপণ উৎসবকে কেন্দ্র করে গান রচনা করেছেন এবং প্রাচীন ভারতের মুনি ঋষিদের তপোবনের আদলে শান্তিনিকেতন-এর পরিকল্পনা করেছেন। এর লক্ষ ছিল আজীবন বৃক্ষের সাথে থাকা। পল্লী উন্নয়নকে নিশ্চিত করার জন্য তিনি রাজনীতিও করেছেন। পাবনায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সভায় কৃষি, কুটির শিল্প, কৃষি ঋণ ও সমবায় ভিত্তিক পল্লী উন্নয়নের জন্য বাস্তব সম্মত একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। কৃষকদের তিনি খুবই ভালোবাসতেন। কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন।
১৮৯১ সালে পতিসরে কবি প্রথম আসেন। সেখানে চর্মসার, শীর্ণ, অনাহারক্লিষ্ট চলমান নরকংকালবত কৃষক প্রজার ব্যথায় সমভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। কৃষকের উন্নতির অদম্য আগ্রহ ছিল কবির। তিনি তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয়। কৃষি উন্নয়নকল্পে পতিসরে কৃষি, তাঁত ও আখ সমবায় সমিতি গডে তোলেন। নিরক্ষর ও গরিব কৃষকদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। নোবেল পুরস্কার এর অর্থের এক লক্ষ আট হাজার টাকা মূলধন হিসাবে প্রদান করেন। তিনি পতিসরে কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে ট্রাক্টর ব্যবহার করেন। আমেরিকায় অর্জিত অভিজ্ঞতায় নিজেই তা চালনা করেন। রবি ঠাকুরের ইচ্ছায় রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদার কে আমেরিকায় কৃষি শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য পাঠান। পরবর্তী বিভিন্ন কাজে কবি তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নেন। আত্ননির্ভরশীল হওয়ার জন্য তিনি জমিদারির বিশাল অঞ্চলকে জোনিং বা বিভাগ পদ্ধতি চালু করেন। হিতৈষী সভা চালু করার উদ্যোগ নেন। হিতৈষী সভা মূলত কৃষি পরিবারগুলো দ্বারা সদস্য নির্বাচিত করত। এই সভায় উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ কৃষি পরিবারগুলো মঙ্গল ও উন্নতি করা। তিনি কৃষি কৃষকদের তথা গ্রামীণ চিন্তা ভাবনাগুলো নান্দনিকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। ধর্মগোলা (শস্য ব্যাংক), পঞ্চায়েত রাজ এসব ধারণা গুলো রবি ঠাকুরের মাথা থেকেই এসেছে। শুধু কৃষিই নয় বরং হস্তশিল্প, কুটির শিল্পের প্রতিও তার বিশাল অবদান রয়েছে। পতিসারে স্কুলে তিনি সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করেন। পতিসারে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষ এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উন্নয়নের জন্য সমবায় ভিত্তিতে তিনি চাল কল চালুর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন। কৃষকদের দুরাবস্থা থেকে উৎরানোর ব্যাপারে তিনি দিনের পর দিন এবং রাতের পর রাত চিন্তা ভাবনা করতেন। তিনি নিজেই গ্রামীণ কৃষিজ অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতিকল্পে এক্সপেরিমেন্ট করা শুরু করেন। তিনি শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি মনে করেন, কৃষি তথা কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে কৃষির আধুনিকায়ন একমাত্র সোপান। কৃষির আধুনিকায়ন বলতে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ, শক্তি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্বাচন এবং ফসল উৎপাদনে প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগ ছিল রবি ঠাকুরের। গতানুগতিক কৃষি বিদ্যাকে পরিহার করে বিজ্ঞান ও শক্তির দ্বারা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় তার চিন্তা ছিল সব সময়। কবি সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের বরপুত্র, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির উৎসাহি। কাল্পনিক শক্তির পাশাপাশি বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় আবদ্ধ করেছিলেন কৃষি সেক্টরকে। চাহিদা ও বাজার দর এর বিষয় ভেবে চিন্তে নতুন ফসলের কথা বলতেন। কৃষককের অর্থনৈতিক লাভের কথা ভাবতেন। নতুন নতুন জাত চাষে উৎসাহিত করতেন। খামার পরিকল্পনা, ফসল পরিকল্পনা এমনকি কৃষিকাজের কৌশলের ব্যাপারে রবি ঠাকুরের উদ্যোগ ছিল। কৃষি বিজ্ঞানে জ্ঞানার্জন না করেও তিনি যেন একজন পরিপক্ক কৃষিবিদ। সাহিত্যে নিজস্ব এক জগত সৃষ্টির পাশাপাশি কর্মি হিসাবে কৃষিতে গবেষণা, আধুনিক কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার, সমবায়, কৃষি ঋণসহ সার্বিক উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যা বর্তমান সময়ের কৃষির উন্নয়নের ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। রবিঠাকুর চেতনার গভীরে লালন করতেন ‘কৃষিই বাংলার কৃষ্টি’।