বকুল হাসান খান, ধামরাই থেকে: কৃষি প্রধান আমাদের দেশের প্রধান ফসল ধান। ধান ও অন্যান্য দানাশস্য চাষের জন্য অধিকাংশ জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা নির্মাণের ফলে প্রতি বছর চাষের জমি কমে যাচ্ছে। গত তিন দশকে দেশে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর কৃষি জমি কমে গেছে এবং এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দানাশস্যের পাশাপাশি শাক-সবজিকে তীব্র প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। কৃষি জমি হ্রাসের ফলে বিকল্প উপায়ে শাক-সবজি উৎপাদনের কৌশল নিয়ে নতুন করে এখনই ভাবতে হচ্ছে। এ কৌশলের মধ্যে-ভাসমান পদ্ধতিতে শাক-সবজি চাষ, ঘেরের আইলে সবজি চাষ, বস্তায় সবজি চাষ, হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ ইতোমধ্যেই দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে জনপ্রিয়তার মুখ দেখতে শুরু করেছে। শাক-সবজির পাশাপাশি মসলা ও স্ট্রবেরির উৎপাদনও স্বল্প আকারে শুরু হয়েছে।
আমাদের দেশে শীতকালে বেশি শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। বর্ষার সময় দেশের বেশিরভাগ জমি পানিতে নিমজ্জিত থাকার ফলে ফসল তথা সবজি আবাদ করা যায় না। তাই দেশের নীচু ও জলমগ্ন এলাকাতে ভাসমান ধাপ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজেই শাক-সবজি উৎপাদন করা যেতে পারে।
যে সকল এলাকায় ভাসমান ধাপে ফসল উৎপাদন করা যায় সে এলাকাগুলো হলো – বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি।
এছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ জেলাগুলোর বন্যাপ্রবণ নিম্ন এলাকায় ভাসমান পদ্ধতিতে শাক-সবজি ও মসলা আবাদ করা যায়।
ভাসমান ধাপ তৈরির বিভিন্ন উপকরণ:
ভাসমান ধাপ তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে- কচুরীপানা। তাছাড়া আমন ধানের খড়, বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ যেমন- কুটিপানা, টোপাপানা, কাঁটা শ্যাওলা, সোনা শ্যাওলা, দুলালীলতা, বিন্দাললতা প্রভৃতি ব্যবহৃত হয় । এছাড়াও বাঁশ, নারকেলের ছোবড়ার গুড়া, তুষ, নৌকা প্রভৃতি প্রয়োজন।
কেমন হবে ধাপের আকার?
প্রতিটি ছোট আকারের ধাপের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার, প্রস্থ ২ মিটার ও উচ্চতা ১ মিটার । প্রতিটি বড় আকারের ধাপের দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার, প্রস্থ ২ মিটার ও উচ্চতা ১ মিটার।
ধাপে ফসল চাষের সময়কাল:
যেসব এলাকা সারা বছর বা বছরের কিছু সময়ে জলাবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং সেসব জলাবদ্ধ স্থানে যদি কচুরীপানা থাকে, তবে শুধুমাত্র সেই কচুরীপানা ব্যবহার করে সারা বছর ধাপ তৈরি করে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন বা সারা বছর উৎপাদিত হয় এমন সবজি ও সবজির চারা উৎপাদন করা যায়। সাধারণত মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে পার্শ্ববর্তী নদী, খাল অথবা জলাভুমি থেকে এই কচুরীপানা সংগ্রহ করা হয়। ভাসমান ধাপে সারা বছর ফসল উৎপাদন খুবই লাভজনক। যেসব এলাকায় সারা বছর জলাবদ্ধ থাকে না বা পানি থাকে না সেসব এলাকায় স্বাভাবিক নিয়মে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাসমান ধাপে মৌসুমি সবজি চাষ করা যায়।
ভাসমান ধাপে ফসল চাষে কিছু অসুবিধার কথা মাথা রাখা ভালো। খুব বেশি স্রোতে ও গভীর পানিতে না করাই ভালো। ইঁদুর, জোঁকের আক্রমণ ও দুর্গন্ধের সৃষ্টি যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
তবে, ভাসমান ধাপে ফসল চাষের সুবিধা অনেক:
# বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান ধাপে সবজি ও মসলা চাষ একটি লাগসই প্রযুক্তি।
# নিচু ও পতিত জলমগ্ন অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা যায়।
# স্থায়ী জলাবদ্ধ এলাকায় (খাল, হাওড় বা হ্রদ ) সারা বছর এ পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষ করা যায়।
# পরিবেশ বান্ধব ও জৈব পদ্ধতিতে ফসল আবাদ করা যায়।
# চাষের খরচ তুলনামুলকভাবে খুবই কম।
# সেচের প্রয়োজন পড়ে না।
# খুব কম সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা যায়।
# পল্লির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও সহজেই পুষ্টির যোগান বাড়ানো যায়।
# দরিদ্র চাষীদের আয় বাড়ে।
# অতিরিক্ত বৃষ্টি ও মৌসুমী বন্যায় ফসলের কোনো ক্ষতি করে না।
# জলাবদ্ধ এলাকার জলজ আগাছা ও কচুরীপানার সদ্ব্যবহার হয়।
# পরিবারিক শ্রমের সদ্ব্যবহার হয়।
# মৌসুম শেষে ধাপ পচিয়ে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার উৎপাদন করা যায় যা পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় কাজে লাগে।
# একই জমিতে পরিকল্পিতভাবে শাক-সবজি, মাছ ও মসলা চাষ করা যায়।
লেখক: ড. বকুল হাসান খান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম