অদ্ভুত এক জলচর পাখি হাঁস, পৃথিবীর সব হাঁস এসেছে বুনোপাখি ম্যালরড থেকে, আর পৃথিবীর সব উন্নত জাতের হাঁসের সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ার জল জাঙ্গালের বুনোহাঁস থেকেই। হাঁসের চামড়ার নিচে আছে চর্বির একটা চাদর এজন্য এদের শরীরে পানি বসে না।
আমাদের দেশে লেয়ার মুরগির তুলনায় ডিমপাড়া হাঁসের খামার খুবই কম। বাজারে হাঁসের ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অনেকেই খামারের মুরগির ডিম খেতে কম পছন্দ করেন, কারণ- কখনো কখনো লেয়ার খামারে এন্টিবায়টিকসহ বিভিন্নি প্রকার ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হয়ে থাকে। যেহেতু হাঁসের রোগবালাই খুব কম, সে কারণে হাঁসের খামারে তেমন কোন ওষুধের প্রয়োজন হয় না। হাঁসের ডিম আকারে বড়, খাদ্যমান উন্নত ও খুবই পুষ্টিকর।
হাওর, বিল, নদী এলাকায় হাঁসের খামারে অতিরিক্ত খাদ্য পর্যাপ্ত লাগে না। হাঁস একেবারে প্রাকৃতিক পানি থেকেই মাছ, ঝিনুক, শামুক, পোকামাকড়, জলজউদ্ভিদ ইত্যাদি খেয়ে থাকে তাই তৈরি খাদ্যের প্রয়োজন বেশ কম। পুকুরে হাঁস চাষ করলে সার ও মাছের খাদ্য ছাড়াই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।
মুরগির চেয়ে খাঁকি ক্যাম্বেল হাঁস বেশি ডিম দেয়, তা ছাড়া এই জাতীয় হাঁসের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা বা খাদ্য লাগে না। ফলে বাণিজ্যিকভাবে এই জাতের হাঁসপালন ব্যাপকভাবে লাভজনক। তাই কৃষকরা এই হাঁসের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ক্যাম্বেল হাঁসের জন্য কম জায়গা লাগে। প্রতিটি হাসের জন্য গড়ে ২-৩ বর্গফুট জায়গা হলেই চলে। এবং এদের প্রতি মাথাপিছু খরচ হয় গড়ে ২০ টাকা।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের সুবিধা
১. বছরে ২৮০-৩০০টি ডিম দেয়। ২-৩ বছর বয়স পর্যন্ত ডিম দেয়, সেখানে লেয়ার মুরগি ডিম দেয় দেড় বছর পর্যন্ত।
২. সবাই হাঁসের ডিম খেতে পছন্দ করেন।
৩. হাঁসের বাচ্চার দাম খুব কম ১২ টাকা সেখানে মুরগির বাচ্ছার দাম ৬০-৬৫ টাকা।
৪. হাঁসের ডিমের সাইজ বড়।
৫. ১ হাজার মুরগির চেয়ে ১ হাজার হাঁস পালন করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে।
৬. ডিম উৎপাদন কমে গেলে ৩ বছর পর হাঁসগুলো মাংস হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যাবে। হাঁসের মাংস মুরগির চেয়ে সুস্বাদু।
৭. মুরগি সব দিন ধরে ডিম দেয় কিন্তু হাঁস সকাল ৯টার মধ্যে ডিম পাড়া শেষ করে। ফলে নজরদারির খরচ কম লাগে।
৮. খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস ১৭-১৮ সপ্তাহ বয়সেই ডিম দেয়।
৯. নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও ফেনী সরকারি হাঁস প্রজনন খামার থেকে ১ দিনের বাচ্চা সংগ্রহ করা যাবে।
খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বৈশিষ্ট্য
এর উৎপত্তিস্থ ইংল্যান্ডে, পালকের রঙ খাকি, মাথা এবং ঘাড় ব্রোঞ্জ রঙের, দেহের আকার মাঝারি- ১.৫-২ কেজি, পা এবং পায়ের পাতায় রঙ হাঁসার হলুদ, হাঁসীর কালো। ঠোটের রঙ হাঁসা নীলাভ, হাঁসী কালো, ডিম দেয় ২৫০-২৭০টি বছরে।
হাঁসের বাসস্থান
মুরগির মতো ততো ভালো বাসস্থান না হলেও চলে। আলো বায়ু চলাচল ভালো থাকতে হবে। বয়স্ক হাঁসপ্রতি জায়গা লাগবে ২-৩ বর্গফুট। উঠতি হাঁসা-হাঁসীর জন্য ১ বর্গফুট জায়গাই যথেষ্ট। বন্য জন্তু বিশেষ করে শেয়ালের হাত থেকে রৰার ব্যবস্থা করতে হবে। থাকার জায়গায় মুরগির লিটারের মতো বিচুলি, তুষ, কাঠের গুঁড়া বিছিয়ে দিতে হবে, এতে আরামে থাকবে পাখিগুলো, ডিম গড়িয়ে যাবে না, ভাঙবে না।
ঘর পূর্ব-পশ্চিম লম্বা করতে হবে। বাণিজ্যিক খামারের ৰেত্রে ঘরের প্রস্থ ১৮-২০ ফুট, উচ্চতা ৬ ফুট এবং দৈর্ঘ্য হাঁসের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করতে হবে।
ঘর দেশি সামগ্রী – বাঁশ, টিন, ছন, খড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি করা যায়। ঘরের তাপমাত্রা ৫৫-৭৫% ও আর্দ্রতা ৩০-৭০% হাঁসের জন্য অনুকূল। লেয়ার হাঁসের জন্য ১৪-১৬ ঘণ্টা আলো দরকার। ৩০০ বর্গফুট স্থানের জন্য ১টি ৬০ওয়াটের বাল্ব দরকার। ঘরের চারপাশে তারের জাল দ্বারা ঘিরে দিতে হবে।
পানি ছাড়া হাঁস পালন
মানুষের খুব একটা ভুল ধারণা আছে হাঁস পালনে পানি লাগে। প্রজননের জন্য হাঁস পুষলে পানি অবশ্যই দরকার। যে কোনো অগভীর ডোবা বা ট্যাংক, গভীরতা যার ৯ ইঞ্চি আয়তন ৫। এ ধরনের মাপে ১০টি হাঁস অনায়াসে পালন চলবে। শুধু ডিমের জন্য হাঁস পালন করলে মুরগির মতো ‘ডিপলিটার’ পদ্ধতিতে অর্থাৎ মেঝেতে ৩ ইঞ্চির মতো শুকনো কাঠের গুঁড়া, তুষ বিছিয়ে হাঁস পালন চলবে। এভাবে পালন করলে মুরগির মতো হাঁসকেও সেই সুষম খাদ্য দিতে হবে।
বাচ্চা ব্রুডিং
হাঁসের বাচ্চা ৩ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ব্রুডিয়ের জন্য ব্রুডার ব্যবস্থা করতে হয়। ব্রুডার-কাম গ্রোয়ার হাউসে হোভায়ের সঙ্গে ১০০ ওয়াটের ৩/৪টি বাল্ব সংযোজন করে তাপ উৎপাদন করা হয়। ৪ দিন বয়স পর্যন্ত ব্রুডারে কাগজের ওপর খাদ্য দিতে হবে।
ব্রুডারের তাপমাত্রা
প্রতি লিটার পানিতে ৮০ গ্রাম গ্লুকোজ ৪ গ্রাম ভিটামিন সি মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত হাঁসের বাচ্চাকে পানিতে ছাড়া যাবে না।
হাঁস কমবেশি ২২ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়ে, ২০ সপ্তাহ বয়সের পরে লেয়ার খাদ্য প্রদান করতে হবে। দৈনিক ১৫০-১৭০ গ্রাম দিতে হবে।
হাঁসের জন্য ম্যাস খাদ্যের নমুনা
সকাল ৯টায় খাবার দেয়ার সময় হাঁসের ডিম সংগ্রহ করতে হয়। ডিম সংগ্রহ করে হাঁস চড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। পরিচিত ও বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। খাবার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। লিটার ভিজতে দেয়া যাবে না। বাসি, পচা খাবার খেতে দেয়া যাবে না। অসুস্থ হাঁস আলাদ করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। মৃত হঁসকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
প্রতিষেধক ব্যবস্থা
৩ সপ্তাহ বয়সে : বুকের মাংসে ১ সষ ডাক প্লেগ টিকা। ১৫ দিন পর : পুনরায় বুকের মাংসে ডাকা প্লেগ টিকা। ৭০ দিন বয়সে: কলেরার টিকা ১/স । ১৩০ দিন বয়সে: ওই।
খামারের আয়-ব্যয়ের হিসাব
১. স্থায়ী খরচ : ক. জমি নিজস্ব খ. লেয়ার সেড ২৫০টি হাঁসীর জন্য ৭৫০ বর্গফুট। প্রতি বর্গফুট ১০০ টাকা হিসাবে ৭৫০০x১০০= ৭ হাজার ৫০০ টাকা। গ. ব্র্বডার, খাদ্য ও পানির পাত্র ২০০০ হাজার টাকা।
২. চলতি খরচ : ক. বাচ্চা ক্রয় ৫০০x১২= ৬ হাজার টাকা। খ. ম্যাস খাদ্য ৫০ হাজার টাকা। গ. আনুষঙ্গিক খরচ ২৫ হাজার টাকা। ঘ. অপ্রচলিত খাদ্য ২৫ হাজার টাকা। মোট খরচ ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
আয় : ৫% মৃত হাঁস বাদে ৫০০-২৫= ৪৭৫টি হাঁস। ক. ২২৫টি হাঁসা বিক্রি বাবদ আয় ২২৫x১০০ = ২২ হাজার ৫০০ টাকা। খ. ২৩০টি হাঁসী থেকে শতকরা ৭০টি ডিম। উৎপাদন (১৮ মাসে) মোট ডিম ৮৬ হাজার ৯৪০টি x৫= ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকা। গ. ২৪৫টি (২৩০+১৫টি হাঁসা) বাতিল হাঁস বিক্রি ২৪৫x১০০= ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। মোট আয় ৪ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ টাকা।
নিট লাভ : মোট আয়-মোট খরচ ৪ লাখ ৮১ হাজার ৭০০-১ লাখ ৮৩ হাজার = ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০ টাকা।
রোগ বালাই
হাঁস সাধারণত ডাকপ্লেগ, কলেরা, ভাইরাল হেপাটাইটিস, খাদ্যে বিষক্রিয়া/বটুলিজম, সর্দি কাশি ও অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যে কোনো সমস্যায় কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। তবে, ক্যাম্বেল হাঁসের রোগবালাই খুব কম, সে কারণে হাঁসের খামারে তেমন ওষুধের প্রয়োজন হয় না।সূত্র: ফেসবুক
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম