শাহাদাত হোসেন তৌহিদ, ফেনী থেকে: ফেনীর ৬টি উপজেলায় গত কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠেছে অন্তত ৫ শতাধিক গরুর খামার। তুলনামূলক লোকসানের সম্ভাবনা ও রোগব্যাধি কম থাকায় দিন দিন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠছে এসব খামার।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহযোগিতায় এ ধরনের খামার তৈরির দিকে ঝুঁকছে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত যুবকরা। স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা এসব খামার থেকেই আগামী ঈদুল আজহাতে ৭৬ ভাগ গরুর চাহিদা পূরণ হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। এছাড়াও জেলা জুড়ে কোরবানি করতে চাহিদার ২২ ভাগ ছাগল ও ভেড়া তৈরি রয়েছে বলে জানা যায়।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানায়, গত বছর ফেনীর ৬টি উপজেলায় ২৬ হাজার গরু কোরবানি করা হয়। যার প্রায় ৪০ ভাগই এসেছে গাইবান্ধা, রাজশাহী, রংপুর, জয়পুর, দিনাজপুর, সাতক্ষিরা, বরিশাল, চাপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণ অথবা দাদনখোরদের থেকে টাকা নিয়ে এসব গরু আমদানি করে ফেনীর বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করতেন। গত কয়েক বছর ফেনীতে অতিরিক্ত গরু আমদানি হয়। ফলে অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ীর ন্যায্যদামে গরু বিক্রি না হওয়ায় পাওনাদারের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু এবারের দৃশ্য পুরোপুরি বিপরীত।
কোরবানে দেশীয় গরুর চাহিদা বেশি ও লোকসানের সম্ভাবনা কম থাকায় অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাণিজ্যিক খামার গড়ে তুলেছেন। এসব খামারে বর্তমানে ১৯ হাজার ৭৬৯টি গরু বিক্রির জন্য তৈরি আছে। যা জেলায় কোরবানি গরুর মোট চাহিদার ৭৬ ভাগেরও বেশি। জেলায় ৪০৯টি নিবন্ধনকৃত বাণিজ্যিক খামারে এসব গরু তৈরি করা হচ্ছে।
ফেনীর খামারগুলোতে শংকর ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও দেশি জাতের গরু সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। তবে বেশি মাংস উৎপাদনে সক্ষম ও বীজ সহজলভ্য হওয়ায় ফ্রিজিয়ান, আর স্বাদ বিবেচনায় দেশি জাতের গরুই বেশি পালন করা হচ্ছে।
এছাড়াও অনেকগুলো অনিবন্ধিত খামারেও কোরবানিযোগ্য পশু পালন করা হচ্ছে। তবে প্রাণিসম্পদ অফিসের আরেক হিসাবমতে, ফেনীতে বর্তমানে খামার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে পালিত গরুর সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। এসব গরুর বেশিরভাগই কোরবানির বাজারে বিক্রির জন্য তোলা হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ক্ষুদ্র খামারি জামাল উদ্দিন বলেন, “শুধুমাত্র কাঁচা ও শুকনা খড়, ভুষি খাইয়ে তার খামারে গরু পালন করা হচ্ছে।”
তিনি জানান, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গরুগুলো দ্রুত মোটাতাজা করতে তিনি হরমোন বা ইউরিয়া সারমিশ্রিত প্রক্রিয়াজাত খাবার দিচ্ছেন না। কারণ ওইসব খাবার খেয়ে গরু রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। নড়াচড়া কম করে। ফলে ক্রেতারা ওই গরু কিনতে চান না। তার খামারে প্রতি গরু পালনে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয় বলে তিনি দাবি করেন।
পল্লি পশু চিকিৎসক কোরবান আলী জানান, ব্যক্তিগত পর্যায়ে পালিত গরুর জন্য তেমন ওষুধের দরকার হয় না। তবে খামারের গরুর রোগবালাই তুলনামূলক বেশি হয় বলে বছরে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত ওষুধ খরচ লাগতে পারে।
ফেনীর আদর্শ গরু খামারী ও পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল জানান, তিনি গত তিন বছর আগে নওগাঁ থেকে কয়েকটি গরু এনে খামার শুরু করেন। ওই বছরই গরুগুলো বিক্রি করে তিনি কয়েক লাখ টাকা লাভ করেন। পরে তিনি প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরামর্শে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে গড়ে তোলেন বাণিজ্যিক গরু খামার। বর্তমানে তার খামারে ২৬০টি গরু রয়েছে। এসব গরু তিনি কোরবানের ঈদে বিক্রি করার জন্য তৈরি করছেন। বিগত ৬ মাসে তার খামার থেকে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ক্রেতারা ৫ শতাধিক গরু ক্রয় করেছেন। ফেনী জেলায় নিজের হাতে গড়া খামারটিকেই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক খামার বলে দাবি করেন এ জনপ্রতিনিধি।
ফেনীতে সবচেয়ে বেশি গরু বেচাকেনা হয় পাঁচগাছিয়া বাজারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী এ বাজারে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ কোটি টাকার গরু ক্রয় বিক্রয় হয়। নিকটবর্তী বিভিন্ন উপজেলার সৌখিন ক্রেতারা চাহিদা ও রুচিসম্মত গরু কিনতে ভিড় জমায় এ বাজারে। ক্রেতা-বিক্রেতার নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দিনরাত কাজ করে থাকেন। দূর দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতাদের জন্য বাজার কর্তৃপক্ষ থাকার ব্যবস্থা করায় দিন দিন এ বাজারটিতে গরু বাজার বড় হচ্ছে। এছাড়াও ফেনী শহরের সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠেও প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে। ফেনীর প্রাচীন বাজার লস্কর হাট, লেমুয়া ও উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয় কোরবানির পশু।
এদিকে জেলায় গতবছর ১৯ হাজার ছাগল ও ভেড়া কোরবানি করা হলেও চাহিদার তুলনায় ফেনীতে এ পশুর অপ্রতুলতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতে, ফেনীতে এবারও ২০ হাজারের বেশি ছাগল ও ভেড়া কোরবানি হতে পারে। এর বিপরীতে ৪ হাজার ৪১৬টি পশু কোরবানিযোগ্য ছাগল রয়েছে। যা মোট চাহিদার ২২ ভাগ মাত্র।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান জানান, ফেনীতে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করতে গরু খামারগুলো বড় ধরনের ভূমিরা রাখছে। খামারীরা যাতে কোরবানির পশুতে ক্ষতিকারক কোনো ওষুধ অথবা ইনজেকশান ব্যবহার না করতে পারে সে জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন এবং খামারীদের প্রয়োজনীয় পরাশর্ম দিয়ে আসছেন। এছাড়াও গো-খাদ্য ও ওষুধ বিক্রেতাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
জেলার যেসব স্থানে পশুর হাট বসে
কোরবানির ঈদের আগে ফেনী জেলার পাঁচটি পৌরসভা ও ছয়টি উপজেলায় স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ১৩৯টি পশুর হাট বসে থাকে। এর মধ্যে ফেনী পৌরসভা ও ফেনী সদর উপজেলায় ৪১টি, দাগনভূঁঞা পৌরসভা ও উপজেলায় ২৯টি, সোনাগাজী পৌরসভা ও উপজেলায় ২৮টি, ছাগলনাইয়া পৌরসভা ও উপজেলায় ২১টি, পরশুরাম পৌরসভা ও উপজেলায় ১০টি এবং ফুলগাজী উপজেলায় ১০টি পশুর হাট বসে থাকে।
ফেনীর বড় পশুর হাটগুলো হচ্ছে-পাঁচগাছিয়া বাজার, শহর পৌরসভা চত্বর ও কলেজ রোড, সদর হাসপাতাল মোড় (সিও কার্যালয়), লেমুয়া বাজার, লস্করহাট বাজার, মোহাম্মদ আলী বাজার, নতুন রানীর হাট, ফাজিলপুর বাজার, খাইয়ারা বাজার, ধলিয়া বাজার, লক্ষ্মীয়ারা বাজার, বিরলী বাজার, সুন্দরপুর বাজার, আমিন উদ্দিন বাজার, গোবিন্দপুর হাজীর বাজার, কৃষ্ণ মজুমদার হাট, ছনুয়া বাজার, বক্তার মুন্সি বাজার, সোনাগাজী বাজার, আমিনউদ্দিন মুন্সি বাজার, নবাবপুর বাজার, কাজিরহাট, কেরামতিয়া বাজার, ওলমা বাজার, চর সোনাপুর বাজার, ছাগলনাইয়া জমদ্দার বাজার, মির্জার বাজার, বাংলা বাজার, শুভপুর বাজার, চাঁদগাজী বাজার, পাঠাননগর, মুহুরীগঞ্জ বাজার, করৈয়া বাজার, বক্স মাহমুদ বাজার, ফুলগাজী বাজার, মুন্সিরহাট বাজার, জিএম হাট, আমজাদ হাট, সুবার বাজার, ধনিকন্ডা বাজার, পরশুরাম বাজার, সালধর বাজার, দাগনভূঞার মাতুভূঞা বাজার, বেকের বাজার, তুলাতলী বাজার, ফাজিলের ঘাট বাজার, সিলোনীয়া বাজার, কোরাইশ মুন্সি বাজার, রাজাপুর বাজার, সিন্দুরপুর বজার, দরবেশের হাট, বৈরাগীর হাট, দুধমুখা বাজার।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম