তরিকুল ইসলাম মিঠু, যশোর থেকে: উচ্চশিক্ষিত চৌগাছার এনামুল হোসেন ইসমাইল। ২০০০ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ২০০৮ সালে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও নেন। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা তার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে যায়। তার একটি পা ভেঙে যায়। ভাঙা পা নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানে তার আর চাকরি করা সম্ভাব হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই তার চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।
ভাঙা পা নিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন কী করা যায়। কীভাবে জীবন নামের চাকাটি সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে ক্ষেতখামারে কাজ করার অভ্যাস ছিল। তাই ঠিক করলেন চাষাবাদে লেগে পড়বেন। তবে এলাকায় যে সাধারণ ফসলের চাষাবাদ হয় সেরকম কিছু নয়। তিনি ব্যতিক্রম ফসলের চাষবাদ করবেন। কারণ এলাকা জুড়েই শুধু বিভিন্ন ধরনের সবজি, কুল, আম, পেয়ারা চাষ করেন এখানকার কৃষকরা। আর এসব ফসল একই সঙ্গে বাজারে ওঠায় কৃষকদের তেমন লাভবান হন না। তাই তিনি চিন্তা করলেন যে ফলের চাহিদা সবসময় আছে সেরকম কিছু চাষ করবেন।
বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ফল দেশেই উৎপানের পরিকল্পনা করলেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিতে থাকেন স্টোবেরি ও ড্রাগনের মতো ফল উৎপাদনের জন্য। এক পর্যায়ে ভিয়েতনামে বহুল উৎপাদিত ড্রাগন ফলের চারা সংগ্রহ করেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
২০১৫ সালে প্রথমে পরীক্ষামূলক দুইবিঘা জমিতে এ ড্রাগনের চারা রোপন করেন তিনি। পরীক্ষামূলক উৎপাদনে সফলতা পাওয়ায় তিনি পরের বছর আরো সাত বিঘা জমিতে এ ফলের চারা রোপন করেন।
এখন চৌগাছা এলাকায় তাকে ‘ড্রাগনভাই’ বলেই সবাই চেনেন। এ ড্রাগন ফল বিক্রি করে তিনি ইতোমধ্যে সাত লাখ টাকা উপার্জন করেছেন। এ বছর তিনি আরো দুই থেকে তিন লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি হবে বলে তিনি জানান। ইতোমধ্যে চৌগাছা এলাকায় তার দেখাদেখি কয়েকজন যুবক এ ড্রাগন ফল চাষে আগ্রহী হয়ে চাষ শুরু করেছেন।
ইসমাইল হোসেন জানান, ড্রাগন দেখতে অনেকটা ক্যাকটাসের মতো। প্রথম দুই বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করতে চার লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। গাছগুলো লতানো হওয়ায় বড় হওয়ার সাথে সাথে জমিতে মাচা তৈরি করে দিতে হয়। মাচাগুলো বাঁশ বাদে কংক্রিটের পিলার তৈরি করে দিলে দীর্ঘদিন ধরে ভালো থাকে। ঝড়-বাতাসে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। একবার ড্রাগন চারা রোপন করলে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। অক্টোবর মাসে ড্রাগনের কার্টিং লাগাতে হয়। ১৬ থেকে ১৭ মাসের মাথায় ড্রাগন গাছে ফল আসে। পরের বছর মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে ফল বিক্রি শুরু হয়। এ ফল বিক্রি চলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।
তিনি জানান, মাঠ থেকেই প্রতিকেজি ফল ৪শ থেকে সাড়ে ৪শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রথম বছর উৎপাদন খরচ বেশি হলেও দ্বিতীয় বছরে জমিতে সার-পানি-পরিচর্যা ছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই। সেজন্য এফল চাষে বেশি লাভজনক বলে তিনি জানান।
তিনি আরো জানান, প্রথমে চাষ করতে গিয়ে খরচ একটু বেশি হয়েছিল। পরের বছর বিঘাপ্রতি বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করতে পারলে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার ফল বিক্রি করা সম্ভব। ঢাকাসহ সারা দেশে ফলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় বাজারেও ফলটি বিক্রি হচ্ছে।
ড্রাগন চাষী ইসমাঈল হোসনের কাছে এত ফল থাকতে এফল চাষের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি একজন শিক্ষিত যুবক। এ এলাকায় যেসব ফল চাষাবাদ হয় সব সময় সেগুলোর ভালো দাম পাওয়া যায় না। তাই আমি স্মার্টফোনে ইন্টারনেটে সার্চ দিতে থাকলাম কোন ফলের চাহিদা আছে বিশ্বজুড়ে। সেখানে দেখলাম ড্রাগন চাষের কথা। সেখান থেকে এফলের চাষাবাদ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করি। এরপর চারা সংগ্রহে লেগে পড়ি। এভাবেই আমার এ ড্রাগন ফল চাষে জড়িয়ে যাওয়া।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কেএম শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, “ড্রাগন বিদেশি ফল। যে কারণে আমাদের দেশে এর চাষাবাদ এখনো ছড়ায়নি। প্রথম প্রথম চাষাবাদ হচ্ছে বলে ফলটির দাম পাওয়া যাচ্ছে। যখন ফলটি মাঠে মাঠে উৎপাদন হবে তখন দাম কমে যাবে।”
তবে নিজ উৎদ্যোগে এ ধরনের চাষাবাদ করার জন্য ইসমাইলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
যশোর বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রো ফুড প্রসেসিংয়ের অধ্যাপক ড. কেএম দেলোয়ার হোসেনের কাছে ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ ফলটি ক্যাকটাস গোত্রীয় ফল। ফলটি দেখতে ‘সবুজ ক্যাকটাস’। এটি একটি আঁশজাতীয় ফল। এটি ভিয়েতনাম ও মধ্য আমেরিকায় সাধারণত চাষাবাদ হয়ে থাকে। ড্রাগন ফল দেখতেও খুব আকর্ষণীয়। তবে বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে ফলটি ব্যাপকহারে চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবকরা চাকরির প্রত্যাশিত না হয়ে দেশের মাটিতে এফল চাষ করে লাভবান হতে পারেন। ফলটিতে ক্যালোরি খুব কম। ফলে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ ও আয়রণ রয়েছে। এটি শরীরের চর্বি ও রক্তের কোলেস্টরেল কমাতেও সাহায্য করে।”
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম