গাভীর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা কাঙ্খিত পর্যায়ে ধরে রাখতে হলে গাভীকে সুষম ও সঠিক পরিমাণে খাদ্য প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। গরুর সুষম খাদ্য তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ হলো- খড়, সবুজ ঘাস, দানাদার খাদ্য এবং পানি।
১০০ কেজি দৈহিক ওজন বিশিষ্ট একটি গাভীর জন্য সাধারণত ১-২ কেজি খর, ৫-৬ কেজি সবুজ ঘাস এবং ১-১.৫ কেজি দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হয়।
দানাদার খাদ্য মিশ্রনে গমের ভূষি ৫০%, চাউলের কুঁড়া ২০%, খেসারি ভাঙ্গা ১৮%, খৈল ১০% খনিজ মিশ্রণ ১% এবং আয়োডিন লবণ ১% থাকা প্রয়োজন। দুগ্ধবতী গাভীর ক্ষেত্রে প্রথম ১ লিটার দুধ উৎপাদনের জন্য ৩ কেজি দানাদার খাদ্য এবং পরবর্তী প্রতি ৩ লিটার দুধ উৎপাদনের জন্য ১ কেজি হারে দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হয়।
নিম্নে ২৫০- ৩০০ কেজি দৈহিক ওজনের দুগ্ধবতী গাভীর (দৈনিক দুধ উৎপাদন ১৩ লি.) জন্য সুষম খাদ্য তালিকা দেয়া হলো।
উপাদান দৈনিক প্রদেয় পরিমাণ
১। কাঁচা সবুজ ঘাস
৯-১২ কেজি
২। শুকনো খড়
৩-৪ কেজি
৩। দানাদার খাদ্য মিশ্রণ
৪-৭ কেজি
গাভীর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে খাদ্যে পাচ্যতা, পুষ্টিগুণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
ভুট্টার (Corn) খাদ্য গুনাগুণ:
প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরী ৩৬৫, ফ্যাটঃ ৪.৭ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ৩৫ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ২৮৭ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৭৪ গ্রাম, প্রোটিনঃ ৯ গ্রাম।
গমের ভুষির (Wheat Bran) খাদ্য গুনাগুণ:
প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরী ২১৬, ফ্যাটঃ ৪.৩ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ২ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ১১৮২ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৬৫ গ্রাম, প্রোটিনঃ ১৬ গ্রাম, ডায়েট্রি ফাইবারঃ ৪৩ গ্রাম, সুগারঃ .৪ গ্রাম
কুড়ার (Rice Bran) খাদ্য গুনাগুণ: প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরি ২২৪, ফ্যাটঃ .৯ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ৭ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ৪৪ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৮৬ গ্রাম, ডায়েট্রি ফাইবারঃ ৭৯ গ্রাম, প্রোটিনঃ ৮ গ্রাম।
সবুজ ঘাস চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ:
সবুজ ঘাস সংরক্ষণ: গো-খাদ্য হিসাবে বর্তমানে দেশে কয়েক ধরনের ঘাস চাষ করা হয়ে থাকে যথাঃ নেপিয়ার, জার্মান, প্যারা, গিনি ও ভুট্টা। এসকল জাতের ঘাস অল্প জমিতে অধিক ফলে এবং পুষ্টিগুণ উন্নত। গবাদি পশু লালন পালনে সবুজ ঘাসের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যকীয়। নেপিয়ার ঘাসের কাটিং বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম বৃষ্টির পর পর রোপন করতে হয়। চারা রোপনে এক সারি থেকে অন্য সারির দুরত্ব ১.৫-২ফুট এবং এক চারা থেকে অন্য চারা ১-১.৫ ফুট হওয়া প্রয়োজন। এই ঘাস একটু উঁচু জমিতে রোপন করতে হবে। প্রতি ৪০-৪৫ দিন পর পর কেটে গবাদি পশুকে খাওয়ানো যায়। প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান করা গেলে সারা বছরই এই ঘাসের ভাল ফলন পাওয়া যায়। জার্মান ঘাসও নেপিয়ার ঘাসের মতই চাষ করা যায়। প্যারা ঘাসের কাটিং অল্প পানি যুক্ত জমিতে রোপন করতে হয়। চারা রোপনে এক সারি থেকে অন্য সারির দুরত্ব ১.৫-২ ফুট হওয়া প্রয়োজন। এই ঘাস একটু উঁচু-নীচু, জলাবদ্ধ এমনকি হালকা লোনা পানি যুক্ত জমিতে রোপন করা যায়। প্রতি ৪০-৪৫ দিন পর পর কেটে গবাদি পশুকে খাওয়ানো যায়। এসকল ঘাসের ফলন বছরে একর প্রতি ৪০০০০-৬৫০০০ কেজি। ভুট্টা সাধারণত বর্ষা পানি চলে গেলে রোপন করতে হয় তবে সারা বছরই ভুট্টার চাষ করা যেতে পারে।
ভুট্টা চাষে একদিকে যেমন গবাদি পশুর জন্য সবুজ/খড় জাতীয় খাদ্য উৎপাদিত হয় অন্যদিকে হাঁস-মুরগির দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়। সবুজ ঘাস ৪-৬ ইঞ্চি করে কেঁটে দিলে এর পাচ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং সহজেই গবাদি পশুর শরীরে শোষিত হয়।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর সবুজ ঘাস জন্মে যা সংরক্ষণ করা গেলে সারা বছরই গবাদিপশুকে সবুজ ঘাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। সবুজ ঘাস অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখার একটি পদ্ধতি হলো সাইলেজ প্রস্তুতি। এই পদ্ধতিতে মাটিতে গর্ত করে স্তরে স্তরে সবুজ ঘাস ও শুকনো খর পলিথিনে মোড়িয়ে এবং মোলাসেস ছিটিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে একটু উচু স্থানে গর্ত করতে হয়। সাধারণত ১০০ সিএফটি গর্তে প্রায় ৩ মেট্রিকটন সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করা যায়। গর্তের আকার সাধারণত ৩ ফুট গভীর প্রস্তে তলায় ৩ ফুট মাঝ বরাবর ৮ ফুট এবং মাটি উপরের দিকে ১০ ফুট হবে এবং ঘাসের পরিমাণ অনুযায়ী দৈর্ঘ্য নির্বাচন করতে হয়। গর্ত তৈরির পর বড় পলিথিন গর্তে বিছিয়ে দিতে হবে। এবার ঘাসের পরিমাণের ১৫-২০% শুকনো খর এবং ৩-৪% চিটাগুড় নিতে হবে। চিটাগুড় ৪ঃ৩ অনুপাতে পানির সাথে মিশিয়ে ঘন দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
এবার গর্তে শুকনো খর ও সবুজ ঘাস স্তরে স্তরে সাজাতে হবে এবং চিটাগুড়ের মিশ্রণ সবুজ ঘাসের উপর স্প্রে/ছিটিয়ে দিতে হবে। খর ও ঘাসের স্তর মাটির উপরে ৪-৫ ফুট উঁচু পর্যন্ত সাজাতে হবে এবং যত সম্ভব এটে চাপিয়ে দিতে হবে। এবার সবুজ ঘাসের উপর শুকনো খর বিছিয়ে দিয়ে পলিথিন ভালভাবে এটে দিতে হবে। বৃষ্টি না থাকলে এ প্রক্রিয়া কয়েকদিনেও করা যাবে। এভাবেই সবুজ ঘাস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে।
সাইলো করা ঘাস ১০০ কেজি ওজনের গরুকে দৈনিক ১০ কেজি পর্যন্ত খাওয়ানো যায়।
উপরোল্লেখিত প্রযুক্তি ছাড়াও বর্ষাকালে ভিজা খর সংরক্ষণ, কলাগাছের সাইলেজ তৈরি ও সরাসরি কলাগাছ গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার, ডাক উইড উৎপাদন ও গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার সংক্রান্ত প্রযুক্তি আছে যা খামারিরা ব্যবহার করে গরুর খামার করে লাভবান হতে পারেন।
গো-খাদ্য হিসাবে এলজির ব্যবহারঃ
ক্লোরেলা ও সিনডেসমাস নামক এলজি গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এতে ৫০-৭০% আমিষ, ২০-২২% চর্বি এবং ৮-২৬% শর্করা থাকে যা রূমন্থনকারী গবাদি পশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী। এক্ষেত্রে ১০ফুট লম্বা, ৪ ফুট প্রশস্ত ও ১-২ ফুট গভীর পুকুরাকৃতির গর্ত করে পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে। তারপর আগের দিন ভেজারো ১০০ গ্রাম মাসকলাই ভূষি মিশানো পানি থেকে পানি ছেকে নিতে হবে। এবার কৃত্রিম পুকুরে পলিথিনের উপর ২০০ লিটার পানি দিয়ে তাতে ১৫-২০ লিটার এলজি বীজ ঢেলে দিয়ে ভাল করে মিশাতে হবে এবং ২-৩ গ্রাম ইউরিয়া সার পানিতে মিশাতে হবে।
প্রতিদিন ৩-৪ বার পুকুরের পানি নেরে দিতে হবে এবং ৩-৪ দিন পর পর ২-৩ গ্রাম ইউরিয়া সার পানিতে মিশাতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে পুকুরে অতিরিক্ত পানি যোগ করতে হবে। ১২-১৫ দিনের মধ্যে পুকুরের পানি সবুজ রং ধারণ করবে যা গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। একটি ১৫০ কেজি ওজনের গরু দৈনিক প্রায় ১২ লিটার এলজি খেতে পারে।
জন্মের পর থেকে অন্তত: ৩ মাস বয়স পর্যন্ত বাছুরকে নিয়মিত অন্তত: দুবেলা মায়ের দুধ খেতে দিতে হবে। বাছুরের ওজনের ন্যূনতম ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থ্যাৎ ২০ কেজি ওজনের বাছুরের জন্য দৈনিক অন্তত: ২ লিটার দুধের প্রয়োজন। অন্যথায় বাছুরের স্বাস্থ্য খারাপ হবে এবং কৃমির আক্রমণ হতে পারে।
দু’সপ্তাহ পর থেকে বাছুরকে নরম সবুজ কাঁচা ঘাস ও দানাদার খাদ্য দিতে হবে, এতে পাকস্থলির পরিপক্কতা আসবে এবং হজম শক্তি বাড়বে।
প্রথম সপ্তাহে ২ লিটার, ২য় সপ্তাহে ৩ লিটার, ৩য় সপ্তাহ থেকে ৩ মাস বয়স পর্যন্ত দৈনিক ৪ লিটার, ৪র্থ মাসে ৩ লিটার দুধ এবং একই সময়ে ২য় সপ্তাহ থেকে যথাক্রমে ২৫০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম ও ৭৫০ গ্রাম কাফ স্টার্টার (দানাদার খাদ্য মিশ্রণ) ও পাশাপশি পরিমাণমতো নরম সবুজ ঘাস খেতে দিতে হবে। কাফ স্টার্টারে শতকরা ৫০ ভাগ গমের ভুষি বা ভুট্টা ভাঙ্গা, ২৪ ভাগ ডালের ভূষি ও ছোলা ভাঙ্গা মিশ্রণ, ২৫ ভাগ খৈল ও ১ ভাগ খনিজ লবণ থাকতে হবে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন