পনের বছর আগের কথা। বিদেশে যেতে গিয়ে দালালদের খপ্পরে মালদ্বীপে অবস্থান নিতে বাধ্য হন রবিউল। পড়ে নিঃস্ব রবিউল ২০১১ সালে গ্রামে ফিরে আসেন।
এসে দেখেন সবার ঘরেই কমবেশি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট। গ্রামের মানুষের উৎসাহে বেসরকারি সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে দুটি ছাগল কিনে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ছয় বছরের ব্যবধানে তার ঘরে এখন ৬০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট। সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় রবিউলের মতো হাজারো গল্প মিলবে, যাদের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে বাংলার কালো ছাগল লালন-পালন করে। চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা ঘুরে মূল সড়ক পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট এবং মেঠো পথেও দেখা মিলেছে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের। কোথাও উঠানে, কোথাও বা বাড়ির মাচায় চলছে ছাগল লালন-পালন।
ক্ষেতে ক্ষেতে নেপিয়ার ঘাসের বাণিজ্যিক আবাদ। কারণ ব্যাপকভাবে ছাগল লালন-পালন হওয়ায় এলাকায় এই ঘাসের চাহিদা আকাশচুম্বী।
স্থানীয় কৃষক রমজান আলী জানান, পাঁচ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি নেপিয়ার ঘাস চাষ করছেন। এক মুঠো ঘাস বিক্রি হয় পাঁচ থেকে আট টাকায়। ঘাস বিক্রি করে মাসে ৩০ হাজার টাকার মতো লাভ হয় তার।
দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক খাত হতে পারে- এমন পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিয়ে আসছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় দেশের ১৮ জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২১টি ব্রিডিং ফার্ম। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কিভাবে লালন-পালন করতে হয়, পিকেএসএফ তাদের সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে তা শিখিয়ে দিচ্ছে কৃষকদের।
জানতে চাইলে পিকেএসএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, “অল্প পুঁজি, কম জায়গা ও কম শ্রম দিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে লাভবান হওয়া যায়, যেটা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। পিকেএসএফ দেশের ১৬ জেলার ৩০ উপজেলায় ১৯টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ছাগল লালন-পালনে ঋণ, অনুদান ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে।”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন দিগন্তের হাতছানি দিচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। বিশেষ জাতের এই ছাগল যে শুধুই বাংলাদেশের, সেই স্বীকৃতি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা আসছে নতুন বছরে। ওই স্বীকৃতি মিললে আর কোনো দেশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে না। এটি হবে শুধুই বাংলাদেশের। তখন বিশ্বব্যাপী ছাগলের মাংসের চাহিদা বাড়বে বহুগুণে।
গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চাষ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। সেটি দেশের ২১ জেলায় বাস্তবায়িত হবে। পরে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হবে সব জেলায়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যঅনুযায়ী, বিশেষ প্রজাতির এই ছাগলের উৎপত্তি বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে। তবে ভৌগোলিকভাবে এই ছাগল লালন-পালনের উপযোগী স্থান হলো চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া জেলা। তবে ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য জেলায়ও। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানিও হচ্ছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ড. হোসেন মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘জিআই পণ্য হিসেবে যাতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের স্বীকৃতি মেলে সে লক্ষ্যে আমরা একটি প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা করছি, শিগগিরই স্বীকৃতি মিলবে।’’
অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, সারা দেশে এখন দুই কোটি ৬০ লাখ ছাগল আছে। এর ৮০ শতাংশ অর্থাৎ দুই কোটি ১০ লাখই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। প্রতিবছরই সংখ্যাটা বাড়ছে। এই ছাগল পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এক কোটি মানুষ। অথচ চার বছর আগেও দেশে বিশেষ জাতের এই ছাগলের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৭০ লাখ।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস যেমন সুস্বাদু, তেমনি চামড়াও আন্তর্জাতিকভাবে উন্নতমানের বলে স্বীকৃত। ছাগল উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ। মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। আর সারা বিশ্বে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া কুষ্টিয়া গ্রেড হিসেবে পরিচিত।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন ব্ল্যাক বেঙ্গল নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, অন্য জাতের ছাগলের চেয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গলের মাংসের স্বাদ অনেক ভালো।
জানা গেছে, বাংলার কালো ছাগলকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে।
এ ব্যাপারে ডিপিডিটির রেজিস্ট্রার সানোয়ার হোসেন বলেন, “ব্ল্যাক বেঙ্গলকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে একটি প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। প্রস্তাব নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে শিগগিরই ব্ল্যাক বেঙ্গলকে দেওয়া হবে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি।”
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, “সারা দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গলের লালন-পালন বাড়ছে। চুয়াডাঙ্গার অভিজ্ঞতা সারা দেশে কাজে লাগাতে পারলে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ব্ল্যাক বেঙ্গল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা জরুরি।”
লেখক: আরিফুর রহমান। সংবাদিক।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন