মাগুরা: মাশরুম চাষে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়ে মাগুরা সদর উপজেলার বড়খড়ি গ্রামের বাবুল আক্তার প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তার এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছে জেলা কৃষি সম্পাসারণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন।
মাগুরা সদর উপজেলার বড় খড়ি গ্রামের বাবুল আক্তারের ৫ বছর বয়সে অজ্ঞাত রোগে বাম পা পঙ্গু হয়ে যায়। তার সফল্যের পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের নিরলস পরিশ্রম । ২০০৭ সালে একটি ভাঙ্গা ঘরে তিনি শুরু করেছিলেন মাশরুম চাষ। দীর্ঘ পথচলার একপর্যায়ে জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষের পরিধি বাড়িয়েছেন । বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ৫০ জন দুস্থ নারী নিয়ে গড়ে তুলেছেন মাশরুম নেটওয়ার্ক। বড়খড়ি গ্রামের ৫০ জন দুস্থ নারীই এখন মাশরুম চাষি। কৃষি কাজের পাশপাশি সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে এসব পরিবারের সদস্যরা মাশরুম বাড়তি কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাশরুম চাষে পরিবারের নারী সদস্যদের ভূমিকাই বেশি। এসব নারীদের ঘর গেরস্থালির কাজ ব্যতিরেকে অলসভাবে সময় কাটাতো । এ অলস সময়টাকেই তারা এখন ব্যয় করছেন মাশরুম চাষে। যা থেকে প্রতিমাসে তারা প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার বাড়তি উপার্জনের করছেন ওই সকল নারীরা।ফলে অস্বচ্ছল এসব পরিবারে বর্তমানে ফিরে আসছে আর্থিক স্বচ্ছলতা।
বাবুল আখতার জানান, নিজ বাড়িতে তার একাধিক মাশরুম উৎপাদন কেন্দ্রে মোট ৬০ জন কর্মী কাজ করে। গ্রামের যে ৫০ জন নারী এখন বাড়িতে মাশরুম চাষ করছে মাসিক ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা বেতনে তার মাশরুম কেন্দ্রে কাজ করতো। পরে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে নিজেরাই নিজ বাড়িতে মাশরুম চাষ করছে।
তিনি আরো জানান, তিনি কখনোই চান না তার কারখানায় কেউ আজীবন কাজ করুক। তার লক্ষ্য প্রতিটি কর্মীকে দক্ষ করে গড়ে তুলে একজন সফল মাশরুম চাষি হিসাবে দাঁড় করানো। যাতে করে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। আর এভাবে সারা দেশে মাশরুম চাষ ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেহেতু মাশরুম একটি অনন্য অর্থকরি ফসল। পাশাপাশি এটির ওষুধী গুণসহ সুষম খাদ্য উপাদান হিসেবে রয়েছে ব্যাপক গ্র্রহণযোগ্যতা।
ড্রিম মাশরুম সেন্টার নামে বাবুলের মাশরুম কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, গোটা বাড়ির প্রায় প্রতিটি কক্ষেই মাশরুমের চাষ। এছাড়া রয়েছে মাশরুম বীজ উৎপাদনের জন্য বড় আকারের একটি গবেষণাগার। পাশাপাশি মাশরুম প্রক্রিয়াজাত করন করে সষম খাদ্য রূপান্তর করার জন্য একটি কারখানা।
কথা প্রসঙ্গে বাবুল জানান, তার কারখানায় উৎপাদিত মাশরুম পাউডার ও মাশরুম শুটকি সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েকটি ওষুধ কোম্পানীতে তার মাশরুম সরবরাহ হচ্ছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ তিনি উপার্জন করছেন।
তার দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে তার অধীনে প্রায় ৬০ জন কর্মী কাজ করছে। এ কাজের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে চলছে তাদের সংসার। প্রতি কেজি কাচা মাশরুম তিনি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। শুকনো মাশরুম ১৫০০ টাকা কেজি, পাউডার মাশরুম ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এ ছাড়া গ্যানোডর্মা নামের একটি বাদামী মাশরুম আছে যেটি ওষুধ কোম্পানীতে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রতিমাসে সে নিজ কেন্দ্রসহ তার নেটওয়ার্ক সদস্যদের মাধ্যমে ৫০০ কেজি মাশরুম ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে বিক্রি করে। যা থেকে একটি বড় অংকের মুনাফা অর্জিত হয়।
বাবুল জানান, বাম পায়ের পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করছে সে। অর্থাভাবে লেখাপড়া করা সম্ভব হয় নি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর চায়ের দোকান দেয়াসহ মানুষের বাড়িতে গৃহকর্ম করেছে সে। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে মাশরুম চাষে হাত দেন। প্রতিবন্ধীত্বের কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। যা তাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ও আত্মপ্রত্যয়ী করেছে।
বাবুলের মাশরুম কেন্দ্রে কর্মরত লতা পারভীন নামে এক বিপনন কর্মকর্তা জানান, কৃষিতে ডিপ্লোমা অর্জন করে বর্তমানে বাবুলের সাথে বিপননের কাজ করছেন তিনি। তার সাথে স্নাতকসহ উচ্চশিক্ষিত আরো ২০ নারী উন্নয়ন কর্মী কাজ করে। তাদের প্রত্যেকের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন বাজার এলাকায় গিয়ে সেমিনারের মাধ্যমে মাশরুমের ওষুধী গুণাগুন ও অন্যান্য উপকারিতা তুলে ধরা। বিশেষ করে ডায়বেটিক ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মাঝে তারা মাশরুমের বার্তা পৌঁছে দেন। স্থানীয় একজন পল্লী চিকিৎসক এ কাজে মধ্যস্থতা করেন। যারা মাশরুম খেতে আগ্রহী হয় তারা ওই পল্লী চিকিৎসকের কাছ থেকে বাবুলের ড্রিম মাশরুম সেন্টারে উৎপদিত মাশরুম কিম্বা পাউডার ক্রয় করেন। এভাবে সারা দেশে বাবুলের মাশরুম ছড়িয়ে পড়ছে।
বড় খড়ি গ্রামে সুচিত্রা বসাক, মেনোকা শিকদার জয়ন্তি বিশ^াস, লাকি খাতুন, মহম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, তারা একসময় ৪ হাজার টাকা বেতনে বাবুলের মাশরুম কেন্দ্রে কাজ করতেন। পরে দক্ষতা অর্জন করায় বাবুল নিজে বীজ ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে তাদের বাড়িতে মাশরুম চাষ করিয়েছেন। এখন এ চাষ থেকে প্রতিমাসে পরিবার প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় হয়। যার মধ্যেমে তাদের পরিবারগুলো এখন আগের চেয়ে বেশ স্বচ্ছল।
তারা আরো জানান, তাদের মত বড়খড়ি গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার এখন মাশরুম চাষ করে সফল। যার মূল উদ্যোক্তা বাবুল। বাবুল শুধু তাদের মাশরুম চাষই শেখায় নি। উপরন্তু প্রতি বাড়িতে যে মাশরুম চাষ হয় তা তার মার্কেটিং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। একারণে তারা কখনোই লোকসানে পড়েন না।
মাগুরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পার্থ প্রতিম সাহা জানান, প্রতিবন্ধী বাবুল আক্তার মাশরুম চাষে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মাশরুম চাষের সকল বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাকে কারিগরি দিক ও অন্যান্য বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।
বাবুলের মাশরুম চাষ বিষয়ে মাগুরা জেলা প্রশাসক আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার প্রাশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্প্রতি বাবুলের মাশরুম কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। তার উন্নয়নে আমরা অভিভূত। মাগুরার জন্য সে উন্নয়নের মডেল হতে পারে। সে শুধু নিজে উন্নত হয়নি তার গ্রামকে সে জাগ্রত করেছে। এটি তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। আমরা তাকে সব ধরেনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি। সূত্র: বাসস
“মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে সিভাসু ও বিএফআরআই একসাথে কাজ করবে”
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন