পানি মুরগির প্রতিটি কোষেই জমা থাকে। এর পরিমাণ ৬০-৭০ ভাগ। কোন কারণে ১০ ভাগ পানি শরীর থেকে মলমূএের সাথে বেরিয়ে গেলে মুরগির পানি শূন্যতা (Dehydration) হবে এবং যদি ২০ ভাগ শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে মৃত্যু হবে। সুতরাং পানি শরীরের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পানি শরীরের হজম (digestion), বিপাক (Metabolism) এবং শ্বসনে (Respiration) সাহায্য করে। মুরগির বিপাক এবং পুষ্টির জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান।
পানি মুরগির শরীরে পুষ্টি উপাদান (ভিটামিন, মিনারেল, এমাইনো এসিড) বহনে, এনজাইমেটিক এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সাহায্য করে। এছাড়া পানি শরীরের স্বাভাবিক তাপমাএা ধরে রাখতে এবং বিভিন্ন অঙ্গ ও জয়েন্টের পিচ্ছিলকরণে (Lubrication) সাহায্য করে। শরীরের অতিরিত্ত বাইপ্রোডাক্ট বাইরে বের করে আনার জন্য পানি ক্যারিয়ার বা মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
পানির উৎস: মোরগ মুরগির দেহের বিভিন্ন অংশে পানির বন্টন বা পানির সমতা তার স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মোরগ মুরগির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া,ওজন বৃদ্বি ও ডিম উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ প্রয়োজন তা সাধারণত তিনটি উৎস থেকে পেয়ে থাকে।
ক) খাবার পানি (Drinking water): মোরগ মুরগির বয়স বৃদ্বির সাথে সাথে পানি গ্রহণের পরিমাণ ও বাড়তে থাকে। একটি মুরগি কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করবে তার সাথে পানি পান করার নিবিড় সর্ম্পক রয়েছে। কোন কারণবশতঃ পাখির খাদ্য গ্রহণের তারতম্য ঘটলে তার প্রভাব সরাসরি পানি গ্রহণের ওপর পড়বে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সাধারণত প্রতিটি মুরগি খাদ্য গ্রহণের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ পানি পান করে থাকে। এছাড়া যে সমস্ত খাদ্যে খনিজ পুষ্টি উপাদান আছে তা গ্রহনের সাথে পানি গ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ স্বরূপ খাদ্যে লবণ বা সোডিয়াম সমৃদ্ব কোন পুষ্টি উপাদান বৃদ্বি পেলে পানি গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে খাদ্যে পটাসিয়ামের আধিক্য যেমন ঝোলাগুড় বা ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও পানি গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এই অধিক হাওে পানি গ্রহণ শরীরের জন্য কোন বিরূপ প্রভাব ফেলে না। তবে অধিক পানি গ্রহণের ফলে তুলনামূলকভাবে অধিক পরিমাণ পানি বিষ্ঠা বা মল-মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, ফলে লিটার সব সময় ভেজা থাকে।
খ) খাদ্যের মধ্যে বিদ্যমান পানি: মোরগ মুরগির খাদ্যে প্রায় ১০% জলীয় অংশ রয়েছে। খাদ্য পরিপাক ও বিপাকে এ পানি দেহের জন্য মোট প্রয়োজনীয় পানির ৭-৮% পূরণ করে।
গ) বিপাককালে উৎপাদিত পানি (Metabolic water): খাদ্য হজম বা পরিপাক হওয়ার পরর্বতী পর্যায়ে বিপাককালে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি কিছু পানি উৎপন্ন হয়। এই পানিকে বিপাকীয় পানি বা Metabolic water বলে। এক গ্রাম স্নেহজাতীয় পুষ্টি উপাদান বিপাককালে প্রায় ১.২ গ্রাম পানি উৎপন্ন করে। অনুরূপভাবে ১ গ্রাম আমিষ ও ১ গ্রাম শর্করা জাতীয় পুষ্টি উপাদান থেকে যথাক্রমে ০.৬ ও ০.৫ গ্রাম পানি উৎপাদিত হয়। একটি মুরগির দেহের মধ্যে বিপাক ক্রিয়ায় উৎপাদিত মোট পানির পরিমাণ সহজে নির্ণয় করা যায়। সাধারণত গড়ে প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ করলে বিপাকক্রিয়ায় উৎপাদিত পানির পরিমাণ হবে ৪২ গ্রাম, এই পরিমাণ একটি মুরগির প্রতিদিনের পানির পরিমাণের প্রায় ১৫%। অর্থাৎ খাবার বিপাককালে উৎপাদিত পানি মোট চাহিদার প্রায় ২০% পূরণ করে।
পানি নির্গমণ: প্রধানতঃ দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি মুরগির শরীর থেকে বেরিয়ে আসে।
ক) মল ও মুত্রের মাধ্যমে: কী পরিমাণ পানি মোরগ মুরগির মল ও মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে তা অনেকটা নির্ভর করে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণের ওপর। সাধারণতঃ ব্রয়লার মুরগির বিষ্ঠার (মল ও মূত্র) মধ্যে প্রায় ৬০-৭০% পানি থাকে। আবার লেয়ার মুরগির বিষ্ঠার মধ্যে পানির পরিমাণ থাকে প্রায় ৮০%।
খ) জলীয় অংশ বাষ্পীকরণের মাধ্যমে: উষ্ণ আবহাওয়ায় মোরগ মুরগির অতিরিক্ত গরম থেকে রক্ষা পাবার জন্য হাঁ করে দ্রুত নিশ্বাস নিতে থাকে। এর ফলে ফুসফুস থেকে নির্গত গরম বাতাস শ্বাসনালী ও মুখের মধ্যে জলীয় অংশ বাষ্পীয়করণের ফলে বেশ কিছু পরিমাণ পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং সাথে সাথে শরীরের তাপমাত্রা ও কমতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিগ্রাম পানি বাষ্পীয়করণে প্রায় ৫৭৫ ক্যালরি তাপের প্রয়োজন হয়। কাজেই ওই পরিমাণ তাপ শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে তাপ কমানোর সাথে মোরগ মুরগির শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার মাত্রার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মুরগির ঘরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মুরগি তার শরীরের তাপ কমানোর জন্য অধিক হারে পানি বাষ্পীয়করণের লক্ষ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।
খাবার পানির তাপমাত্রা: মোরগ মুরগিকে সাধারণত পরিবেশগত প্রাপ্ত তাপমাত্রায় পানি সরবরাহ করা হয়। পানির এই তাপমাত্রা আবহাওয়া পরির্বতনের সাথে সাথে পরির্বতিত হতে থাকে। অনেকে বাচ্চা আসার পর প্রথম কয়েকদিন বাচ্চাদের উষ্ণ গরম পানি সরবরাহের পরামর্শ দেয়। যদিও এ পরামর্শের স্বপক্ষে তেমন কোন জোরালো যুত্তি নেই। গরম আবহাওয়ায় মোরগ মুরগির পানি গ্রহনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তবে গরম আবহাওয়ায় ঠান্ডা পানি সরবরাহ করলে পানি গ্রহণের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৩০ ডিগ্রি সেঃ তাপমাএায় অবস্থানরত একটি লেয়ার ফার্মে সাধারণ পানির পরিবর্তে ঠান্ডা পানি সরবরাহ করলে ডিম উৎপাদন ও খাদ্য গ্রহনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। আবার পরিবেশের তাপমাত্রা যখন ২১ ডিগ্রি থাকে তখন মুরগি যে পানি গ্রহণ করে তার চেয়ে ৩০-৫০% বেশি পানি গ্রহণ করে যখন তাপমাএা দাড়ায় ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মুরগি তাপমাত্রার মুরগির পানি গ্রহণের ক্ষেত্রে ড্রিংকারের ধরন ও প্রভাব ফেলে। ঘরের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড থাকলে ডিম পাড়া মুরগি যে পরিমাণ পানি পান করে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এ সে মাত্রা দ্বিগুণ হয়।
নিচের টেবিলে পোল্ট্রির বিভিন্ন ধরনের জাত প্রজাতি ভেদে পানিপানের পরিমাণ প্রদত্ত হল। অবশ্য এ পরিমাণ উৎপাদনের পর্যায় (Stage), স্বাস্থ্যগত অবস্থা এবং খাদ্য গ্রহণের উপর কম বা বেশি হতে পারে।
টেবিল ১: মুরগি দৈনন্দিন পানি গ্রহণের ছক (লিটার/১০০০ মুরগির জন্য)
বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগীর পানি ব্যবস্থাপনা : মুরগীর বাচ্চাকে (লেয়ার বা ব্রয়লার) খুব তাড়াতাড়ি খাবার খাওয়া এবং পানি পান করানো শিখতে হবে। যদি ও মুরগীর বাচ্চার জন্মের পর প্রায় ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত খাবার এবং পানি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে তবু ও ২৪ ঘন্টার মধ্যে পানি পান করানো সবচেয়ে ভাল। ৩৬ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই পানি পান করাতে হবে। দেরীতে খাবার খাওয়ালে এবং পানি পান করালে পরর্বতীতে ফলাফল ভাল হয় না। কারণ এতে শরীরে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হয়। কোন কারণে শরীরে পানিশূন্যতার সৃষ্টি হলে ইলেকট্রোলাইট পানিতে মিশিয়ে সরবরাহ করতে হবে। ট্রাফ পাত্রে বাচ্চা প্রতি জায়গার পরিমাণ এবং ড্রিংকার প্রতি বাচ্চার সংখ্যা টেবিলে দেওয়া হল:
ব্রুডার ঘরে পানির পাত্রের অবস্থান: খাবার পাএের পাশাপাশি পানির পাত্র স্থাপন করতে হবে। খাবার পাত্র এবং পানির পাত্র মুরগির ঘরের মধ্যে এমনভাবে সেট করতে হবে যাতে একটা খাবার বা পানির পাত্র থেকে অন্য একটা খাবার বা পানির পাত্রের দূরত্ব বাচ্চা মুরগির ক্ষেত্রে ৫ ফুটের (১.৫২ মিটার) বেশি না হয়। ঘরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাবার পাত্র এবং পানির পাত্র পরস্পর একটি অন্তর অপরটি সমান দূরত্বে স্থাপন করতে হবে। কখনো হোভারের নীচে পানির পাত্র স্থাপন করতে নেই, এতে পানি বেশি গরম এবং শুকিয়ে যেতে পারে। হোভারের বাইরে এবং ব্রুডার গার্ডেও ১ ফুট (৩০ সেমি) ভিতরে হোভারের অনেকটা কিনারা দিয়ে পানির পাত্র স্থাপন করতে হবে।
লম্বা ট্রাফ পানির পাত্র বা বেল টাইপ (গোলাকার পাত্র) বা ঝর্ণা পাত্র ব্যবহার করা হলে প্রথম দুই দিন পাত্রকে লিটারের ওপর রাখতে হবে। ২-৩ দিন পরে পানির পাত্রকে ১ ইঞ্চি (২.৫ সে:মি) উপরে উঠিয়ে দিতে হবে যাতে পানির মধ্যে লিটার না পড়তে পারে এবং বাচ্চারা সহজে পানি পান করতে পারে। ৭-৮ দিন বয়স থেকে লিটারের ২ ইঞ্চি (৫ সে:মি) উপরে এবং ২৮-৩০ দিন বয়স থেকে বাচ্চার পিঠের সমতলে স্থাপন করতে হবে। নিপল ড্রিংকার ব্যবহার করা হলে সেটা বাচ্চার ৭-৮ দিন বয়সের পর থেকে করাই ভাল এবং এটা এমনভাবে সেট করতে হবে যাতে বাচ্চারা ঘাড় ও ঠোঁট উচুঁ করে পানি পান করতে পারে।
বাচ্চাদের পানি পানের ব্যাপারটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পানির পাত্র শুধু যথেষ্ট সংখ্যায় থাকলে চলবে না, ব্রুডারে আসার পর প্রত্যেকটা বাচ্চা পানি পান করছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। অনেক সময় মনে হয় যে, সবাই পানি পান করছে কিন্তু ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে অনেক বাচ্চাই পানির পাত্রের কাছে যাচ্ছে না বা যেতে পারছে না। এ রকম দেখা গেলে পানির পাত্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং বাচ্চাদেরকে ধরে ধরে পানির উৎস চিনিয়ে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে হাত ধরে পানি পান করাতে হবে।
বাড়ন্ত এবং লেয়ার মুরগির পানি ব্যবস্থাপনা: এক্ষেত্রে খাবার পাত্র এবং পানির পাত্র মুরগির ঘরের মধ্যে এমনভাবে সেট করতে হবে যাতে একটা খাবার বা পানির পাত্র থেকে অন্য একটা খাবার বা পানির পাত্রের দূরত্ব ১০ ফুটের (৩ মিটার) বেশি না হয়। এ বয়সের মুরগির কিছুটা বমি করার স্বভাব আছে তাই বাড়ন্ত এবং লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে ট্রাফ বা বেল বা ঝর্ণা ধরনের পাত্র ব্যবহার করা হলে পাত্রের তলদেশ মুরগির পিঠের সমতল থেকে ২ ইঞ্চি (৫ সে. মি.) উঁচুতে স্থাপন করতে হবে। এতে মুরগি পানির পাত্রের মধ্যে বমি করতে পারবে না এবং পানি ভাল থাকবে। নিপল ড্রিংকার ব্যবহার করতে হলে তা এমন উচ্চতায় স্থাপন করতে হবে যাতে মুরগি ঘাড় উঁচু করে পানি পান করতে পারে অর্থ্যাৎ নিপল মুরগির ঠোঁটের নাগালের মধ্যে থাকবে।
তাপমাএা বেশি থাকলে বাড়ন্ত ও লেয়ার মুরগির জন্য কার্যত এ জায়গার পরিমাণ যথেষ্ট নাও হতে পারে এবং তখন পানির পাত্রে মাথাপিছু জায়গার পরিমাণ বেশি লাগবে অর্থ্যাৎ এতে পানির পাত্রের সংখ্যা বেশি লাগবে। আবহাওয়ার তাপমাত্রা বাড়লে মুরগি যেহেতু পানি বেশি পান করে তাই গরমের সময় নির্ধারিত জায়গার চেয়ে ১৫% বেশি জায়গা বরাদ্দ করা উচিত।
পানি বিশুদ্বকরণ: পানি অবশ্যই জীবাণুমুক্ত হতে হবে। তা না হলে তারা পানিবাহিত রোগের দ্বারা অতি সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। পানি জীবানুমুক্ত সন্দেহ হলে প্রতি ১০০ লিটারে ৫ গ্রাম ভাল মানের ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ২০ মিনিট পরে সরবরাহ করা যেতে পারে। ব্লিচিং পাউডার ভালভাবে সংরক্ষণ করা না হলে এর ক্লোরিন উড়ে গিয়ে জীবানু নাশ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ব্লিচিং পাউডারের বদলে টিমসেন ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ভাল ক্লোরিন ট্যাবলেট পাওয়া গেলে সেটা ও ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ও অন্যান্য পানি পরিশোধনকারী দ্রব্য পাওয়া গেলে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিপ টিউবওয়েলের পানি সাধারণত জীবাণুমুক্ত হয়ে থাকে। এই পানি পরিশোধনের প্রয়োজন হয় না। কখনো কখনো খাবার পানির মাধ্যমে কোন কোন রোগের টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। যে পানিতে টিকা মেশানো হয়েছে সেই পানিতে জীবাণুনাশক মেশানো যাবে না। টিকা মেশানো পানি পান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে জীবাণুনাশক মিশ্রিত পানি পান করতে দেওয়া যাবে। খাবার পানির মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করলে সেই পানিকে ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে পরিশোধন করতে নেই। যে ধরনেরই পানির পাত্র ব্যবহার করা হোক না কেন তা প্রতিদিনই ঘষে মেঝে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। কোন জীবাণুনাশক মেশানো পানি দিয়ে ঘষা মাজার কাজটা করা ভাল। এতে জীবাণু ধ্বংস হয় এবং কোন ছত্রাক জন্মাতে পারে না।
পানিতে অনুজীবের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য পানি পরিশোধনের বিভিন্ন পদ্বতি রয়েছে। যেমন ফুটানো, ছাঁকন, অতিবেগুনি রশ্মির কিরণসম্পাত, রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার ইত্যাদি। এদের মধ্যে শেষোক্ত পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক জারণের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার দেহকোষ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। পানিতে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান নিম্নমাত্রায় প্রয়োগ করা যায় যা পোল্ট্রির জন্য ক্ষতিকর না হলে ও ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস নিধনের জন্য পূর্ণমাত্রায় কার্যকর। এ ধরনের কয়েকটি রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে ২-৫% ডাইমিথাইল এলকাইল বেনজালকোনিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড, ক্লোরিন (৫%, মাত্রা: প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে ৭৫ মিলি), ক্লোরিন ডাইঅক্সাইড (২%), হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (৩৫%, মাত্রা: প্রতি ৪.৫ লিটার পানিতে ৩০ মিলি) , এলকাইল এরাইল, ফেনক্সিপলিগ্লাইকল ইথার আয়োডিন কমপ্লেক্স, আয়োডোফর (১.৬%), ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড/ক্লোরাইড/হাইপোক্লোরাইড,সিলভার/ম্যাগনেসিয়াম/ম্যাঙ্গানিজ/ক্যালসিয়াম/সোডিয়াম/পটাসিয়ামআয়োডাইড বা কার্বনেট লবণ, জৈব এসিডের লবণ ইত্যাদি। এছাড়া সাইট্রিক অ্যাসিড, ভিনেগার, এমোনিয়া পানির লাইন পরিষ্কারক হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
পানির গুণগত মান: পানির গুণগত মান মুরগির ডিম বা মাংস উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। পানির রাসায়নিক দূষণের কারণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যহত হতে পারে। পানি কোন কারণে জীবাণু দ্বারা দূষিত হলে সেক্ষেত্রে দূষিত হওয়ার কারণ বা উৎস চিহ্নিত করে তার প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুরগির জন্য পানির গুণগত মান নিচে ছক আকারে তুলে ধরা হল:
প্যারামিটার ভাল মান সম্মত পানি যা ব্যবহার করা যাবে না
পিএইচ ৫-৮.৫ < ৪ এবং > ৯
এমোনিয়াম (মিগ্রা/লি) < ২ > ১০
নাইট্রাইট (মিগ্রা/লি) <০.১ > ১
নাইট্রেট (মিগ্রা/লি) < ১০০ > ২০০
ক্লোরাইড (মিগ্রা/লি) < ২৫০ > ২০০০
সোডিয়াম (মিগ্রা/লি) < ৮০০ > ১৫০০
সালফেট (মিগ্রা/লি) < ১৫০ > ২৫০
আয়রন (মিগ্রা/লি) < ০.৫ > ২.৫
ম্যাঙ্গানিজ (মিগ্রা/লি) < ১ > ২
লাইম/চুন < ২০ > ২৫
উৎকৃষ্ট জৈব যৌগ (মিগ্রা/লি) <৫০ > ২০০
কলির্ফম ব্যাকটেরিয়া সি.এফ.ইউ/মিলি < ১০০ > ১০০
মোট জীবাণু গণনা সি.এফ.ইউ/মিলি < ১০০,০০০ > ১০০,০০০
পানির রাসায়নিক উপাদানজনিত অসুস্থতা: পানিতে অনাকাঙ্খিত মাএায় দ্রবীভূত অনেক রাসায়নিক উপাদান পাখির জন্য ক্ষতিকর এমনকি প্রাণঘাতী ও হতে পারে। পানির এই সম্ভাব্য রাসায়নিক উপাদানজনিত ঝুঁকি দুইভাবে আসতে পারে। প্রথমত, দুর্ঘটনাজনিত প্রচুর পরিমাণে বিষাত্ত পদার্থ পানিতে মিশে মারাতœক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, পানিতে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান দীর্ঘমেয়াদি ও অতিমাএায় উপস্থিত থাকা। পোল্ট্রি উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানঘটিত সমস্যা নিম্নে প্রদত্ত হল:
পানির লাইনের পরিচর্যা: পানির লাইন যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা বা রক্ষণাবেক্ষনের করা না যায় তাহলে সেখানে জীবাণুর বংশ বৃদ্বি ঘটতে পারে এবং পোল্ট্রির সার্বিক উৎকর্ষতা ব্যাহত হবে। এছাড়া ওষুধ ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের কার্যকারিতা হ্রাস পাবে এবং নিপল ফ্লো এর হার কমে যাবে। নিয়মিতভাবে পানি স্যানিটেশন এবং পানির লাইন পরিস্কার কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে অনুজীব জমা হয়ে পানি দূষণ প্রক্রিয়া প্রতিহত হবে। খোলা ড্রিংকার সিস্টেম কর্তৃক দূষণ প্রতিরোধ অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টসাধ্য কারণ এগুলি উন্মুত্ত থাকায় পোল্ট্রি কর্তৃক পানি পানের সময় মুখ ও নাসিকার শ্লেষ্মা ও বিষ্ঠার কণা দ্বারা পানি প্রায়শ দূষিত হয়ে থাকে।
বন্ধ নিপল সিস্টেম: রোগ জীবাণুর বিস্তার বহুলাংশে রোধ করে কিন্তু তবু জৈব পদার্থের উপস্থিতি বায়োফিল্ম দূরীকরণের জন্য নিয়মিত স্যানিটাইজার ব্যবহার প্রয়োজন। ক্লোরিনেশনের জন্য ড্রিংকারের লেভেলে ৩-৫ পিপিএম ক্লোরিন ডাই অক্সাইড ব্যবহার অথবা অতি বেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করলে ব্যাকটেরিয়ার দূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়। পোল্ট্রির ঘরের পানির প্রবেশ পথের স্থানে এটা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। পানিতে উচ্চ মাএায় ক্যালসিয়াম এর লবণ বা লৌহ থাকলে কপাটিকা এবং ড্রিংকার সিস্টেমের পাইপ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা ঘটলে পানি ফিল্টার করে সরবরাহ করতে হবে।
পানি সম্পর্কে কতগুলো প্রয়োজনীয় উপদেশ:
১) যেহেতু মুরগির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পানি সেহেতু তা পর্যাপ্ত ও বাধাহীন ভাবে সব সময় গ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে। মুরগির পছন্দমত বিশুদ্ধ পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে।
২) প্রতিদিন পানি গ্রহণের পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। পানি কম পরিমাণে পান করলে বুঝতে হবে হয়তো খাবারের দোষ আছে ।
৩) পানি মুরগির নাগালের মধ্যে থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির পাত্র নির্দিষ্ট দূরত্বে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে মুরগিকে পানি হতে বেশি দূরে যেতে না হয়। পানির পাত্রের আকৃতি ও উৎস মুরগির জন্য পর্যাপ্ত হতে হবে। পানি উপচে পড়া চলবে না বা ছিদ্র পথে নষ্ট হওয়া চলবে না। পানিতে ক্ষতিকর খনিজ উপাদান আছে কিনা তা খাওয়ানোর আগে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
৪) প্রতি ৫-৬ মাস পরপর রসায়নাগারের মাধ্যমে পানি পরীক্ষা করে এর ব্যবহার ও উপযুক্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। কোন ক্ষতিকর উপাদান থাকলে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা নিরাপদ মাত্রার মধ্যে আছে কিনা তা দেখতে হবে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব বিশেষ করে সালমোনেলা ও ই কলাই সম্পর্কে সাবধান থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ সমস্যা সমাধানে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (যেমন- Aquaguard, SI Chlor T)
৫) কোন ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়ার জন্য ব্যবহার্য পানি যে কোন ধরনের ওষুধ বা জীবাণুনাশক মুক্ত থাকতে হবে। পানিতে ওষুধ প্রয়োগের সময় পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা পরির্বতনের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ওষুধ প্রয়োগের নির্ধারিত তাপমাত্রা সাধারণত ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এ কার্যকর।
৬) মুরগির ঘরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ঠান্ডা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় ত্রুটিমুক্তভাবে ঠোঁট কাটার কারণে মোরগ মুরগি তার প্রয়োজন অনুযায়ী মুরগি পানি পান করতে পারে না। সেজন্য ঠোঁট কাটার জন্য অভিজ্ঞ লোকের মাধ্যমে সঠিকভাবে ঠোঁট কাটা নিশ্চিত করতে হবে এবং ঠোঁট কাটার পরে কয়েকদিন যাবতীয় ড্রিংকারে পানির উচ্চতা বা পরিমাণ বেশি রাখতে হবে যেন মুরগি সহজে তার প্রয়োজনীয় পানি পান করতে পারে।
৭) মুরগি কোন রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমেই তার পানি গ্রহণের পরিমাণ কমে যায় এবং পরর্বতীতে রোগের অন্যান্য লক্ষণসমূহ দেখা দেয়। সেজন্য অল্প পরিমাণ পানি গ্রহণকে রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগাম সংকেত হিসাবে বিবেচনা করে রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার: জীবন ধারনের জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়। পোল্ট্রি উৎপাদনের সমগ্র সময়ে সর্বদা পরিষ্কার ও বিশুদ্ব পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, যথেচ্ছ পানি পানে বাধা বা পানিতে দূষণ ঘটলে পোল্ট্রির দৈহিক বৃদ্ধি যেমন বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি সার্বিক উৎকর্ষতা ও দারুনভাবে ব্যাহত হয়ে থাকে। বয়স, লিঙ্গ, পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা, পানির তাপমাত্রা, ড্রিংকার সিস্টেমের শ্রেণিসহ নানাবিধ ফ্যাক্টর রয়েছে যা দ্বারা পানি পান ব্যাহত হতে পারে। পানির ভৌত গুণাবলী, ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করতে হবে যাতে পোল্ট্রির সার্বিক উৎকর্ষতা সর্বদা সমুন্নত থাকে।
লেখক: ডা. এ এইচ এম সাইদুল হক
সূত্র: 1. Water: The forgotten nutrient (Vetcare technical bulletin) 2. Water Requirements of Poultryby Dr. Jacquie Jacob, University of Kentucky
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/ মোমিন