সারা দেশে ছাদকৃষির প্রসার আমরা লক্ষ্য করছি। গত আড়াই বছর আগে হৃদয়ে মাটি ও মানুষের পক্ষ থেকে ছাদকৃষির যে উদ্যোগটি নেওয়া হয়, সেটি মূলত ছাদকৃষি সম্প্রসারণে আমার দ্বিতীয় প্রয়াস। এর আগে আশির দশকের শেষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’-এ ছাদবাগান নিয়ে কাজ করি। সে সময় অনেকেই তাদের ছাদে কাজী পেয়ারার বাগান গড়ে তোলেন। সেই সঙ্গে ফুল ও ফলের চাষ শুরু করেন। ছাদগুলোতে কাজী পেয়ারার বাগান সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তখন অনেক শৌখিন গৃহিণী, কর্মজীবী মানুষের ছাদবাগান গড়ে তুলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেতেন। কাজটি ছিল শৌখিনতার। ছাদে মুরগির খামার গড়ার জন্য অনুষ্ঠানগুলো করেছিলাম। ছাদে ও বারান্দায় সেই ছোট্ট পরিসরে খাঁচায় মুরগি পালনের বিষয়টিই পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে পোলট্রি খামারে রূপ নিল।
সারা দেশের অসংখ্য তরুণ, গৃহিণী থেকে শুরু করে পেশাজীবী এমনকি বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করল পোলট্রি শিল্পে। সেসব গল্প আমি তুলে ধরেছি বিভিন্ন প্রতিবেদনে। একজনের দেখাদেখি আরেকজন গড়েছেন। এভাবে শৌখিন ছাদকৃষির একটি বড় সম্প্রসারণ হয় দেশব্যাপী। কিন্তু আজকের দিনে ছাদকৃষি শুধু শৌখিনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এক অনিবার্য তাগিদে ছাদকৃষির উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেকেই। শহর-নগরে আবাদি জমি নেই। কিন্তু কৃষি অন্তপ্রাণ বহু মানুষ রয়েছেন। তারা নিজস্ব অথবা ভাড়া বাড়ির ছাদে ছাদকৃষির উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেকটা মনের টানে। আবার কেউ কেউ রীতিমতো বাণিজ্যিক উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। তাগিদটি আরও বড় হয়ে দেখা দেয়, কারণ মানুষ সব সময় খুঁজছে বিষমুক্ত বিশুদ্ধ শাক-সবজি ও ফল। ছাদকৃষির মাধ্যমে যেটি অনায়াসেই আসতে পারে। আর পরিবেশ সুরক্ষার বিষয় তো রয়েছেই।
এই সময়ে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বসবাসযোগ্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৭। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে অবশ্যই ঢাকাকে সবুজ করতে হবে। ঢাকায় যেভাবে বেড়ে উঠছে ইট-কাঠ-পাথরের কানন, সেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে না সবুজ। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই সবুজায়নের তাগিদ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন জাপান ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলের ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব মোকাবিলার জন্য ভবন নির্মাণের সময় ছাদে ও কার্নিশে বাধ্যতামূলক প্রশ্বস্ত বাগান গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। তারা ছাদে সবুজের চাষ করাটাকে আইন পাস করে বাধ্যতামূলক করেছে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোকে করা হয়েছে অপরিহার্য। কারণ ওই শহরটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। গড়তে হবে অক্সিজেনের খামার। মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেই পরিবেশটা নেই। আমরা যখন বাড়ি বা অট্টালিকা তৈরি করি, তখন বাড়ির ছাদটা যে সবুজ হওয়া দরকার এই চিন্তাটা আমাদের থাকে না। দু-এক জন বাড়ি নির্মাণের সময় ছাদকৃষির বিষয়টি মাথায় রাখেন। বহুমুখী চিন্তা থেকেই তিনি বাড়ি নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ছাদকৃষিতে সাজিয়ে তোলেন। আমরা যখন নিয়মিত অনুষ্ঠান হিসেবে ‘ছাদকৃষি’ কার্যক্রম গ্রহণ করি, তখন বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে ছিল। এক. ছোট পরিসরে ছাদকৃষি করে আমরা বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর সবজি-ফলের নিশ্চয়তা পেতে পারি। দুই. ছাদকৃষির মাধ্যমে আমরা পরিবেশ সমুন্নত রাখতে পারি। তিন. বাড়ির ছাদটি হতে পারে আয়ের অন্যতম উৎস। চার. মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ছাদকৃষি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এক ক্ষেত্র।
বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে একটা বড় ধরনের শঙ্কা এবং একটি সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে খাদ্যে নানারকম বিষপ্রয়োগ। বিশেষ করে সবজি ও ফলে নানারকম কীটনাশক ও সতেজ রাখার জন্য রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর বিষয়টি নিয়ে সবারই মনে কমবেশি সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন বাজারের বিভিন্ন ফল-ফসলে ফরমালিন দেওয়া হয়, মাছে ফরমালিন দেওয়া হয়। সেটা কতটুকু সত্য বা মিথ্যা তা যাচাই করে দেখা হয়নি। কারণ যাচাই করে দেখার মতো সেরকম কারিগরি দক্ষতাও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নেই। আবার সরকারেরও বাজারের সব পণ্যের রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি পরীক্ষা করার কোনো কার্যক্রম নেই। ফলে আমরা দেখতে পারি না, ফল-ফসলে ফরমালিন বা কোনো রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে কিনা। খাবারের মাধ্যমে আমরা বিষক্রিয়ার শিকার হচ্ছি। কারণ ফসলের ক্ষেতে যে পরিমাণ কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম না মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কীটনাশক প্রয়োগের যতদিন পরে ওই ফসল খাওয়ার উপযোগী হয়, তার অনেক আগেই সেটি বাজারে চলে আসে; হয়তো সকালে কীটনাশক দিয়ে বিকালেই সেই ফসল তুলে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। এসব ফসল নীরব ঘাতকের মতো কাজ করছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো আন্তর্জাতিক ক্যান্সার দিবস। দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ক্যান্সারে মৃত্যুর ঘটনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ১ লাখ ৫০ হাজার রোগী মৃত্যুবরণ করে। প্রতিদিনই বাড়ছে এই সংখ্যা। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার শতকরা সাড়ে সাত ভাগ। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অনেকগুলো কারণের একটি হচ্ছে খাদ্যের বিষক্রিয়া। এই বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে আমাদের প্রয়োজন বিশুদ্ধ উপায়ে খাদ্য উৎপাদন। জৈবিক কৃষির দিকে ফিরতে হবে আমাদের। সে ক্ষেত্রে যারা ছাদকৃষি করছেন তারা ছোট পরিসরে পারিবারিক চাহিদা অনুযায়ী জৈবিক উপায়ে বিভিন্ন সবজি, ফল-ফসলের চাষ করছেন। ইতিমধ্যে অনেকে ছাদকৃষির মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি দেখেছি ছাদে লাউ, ঝিঙে, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরসহ বিভিন্ন সবজি, আম, পেয়ারা, মাল্টা, আখ, ডালিম, জাম্বুরা, কামরাঙা, জামরুলসহ নানান ফলের চাষ করে পারিবারিক চাহিদাপূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
প্রায় ৮০টির মতো ছাদকৃষি পর্ব করে আমি দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-অসরকারি চাকরিজীবী, কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তারা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যার নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে তারা নিজেদের ছাদে একস্তর বা দ্বিস্তর বিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তারা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের একপাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে সহায়তা করছেন। নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন। না, ছাদে শুধু ফল আর সবজির চাষই নয়। ছাদে চাষ হচ্ছে মুরগি, কবুতর, টার্কি, কোয়েলসহ নানা পাখি। চাষ হচ্ছে মাছের। ড্রামে মাছের চাষ করে অনেকে খাচ্ছেন তাজা মাছ। শুনলে হয়তো অনেকে অবাক হবেন, ছাদে চাষ হচ্ছে ছাগল, গাড়ল ও ভেড়ার। তবে আশার কথা হচ্ছে একজনেরটা দেখে আরজন উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন ছাদকৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। ছাদকৃষিকে অর্থনৈতিক সাবলম্বীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন অনেক উদ্যোক্তা। ভালো লাগে যখন অনেকেই বলেন আমার অনুষ্ঠান দেখে তিনি ছাদকৃষি শুরু করেছেন। সম্প্রতি এক আশাব্যঞ্জক চিত্র দেখলাম।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্যবিজ্ঞান অনুষদের তরুণ সহকারী অধ্যাপক শেখ আল আহমাদ নাহিদ প্রফেসর’স কোয়ার্টারের ছাদে গড়ে তুলেছেন সমন্বিত ছাদকৃষি গবেষণা ক্ষেত্র। সেখানে বেশকিছু শিক্ষার্থী সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করছেন তাদের গবেষণা। শেখ আল আহমাদ নাহিদও জানালেন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক অনুষ্ঠানের ছাদকৃষি থেকে। কী নেই তার সেই ছোট্ট ছাদটিতে! সবজি ও ফলের পাশাপাশি খুদেপানা, টোপাপানাসহ অ্যাকুরিয়াম মাছের প্রজননের এক মনোরম গবেষণা কেন্দ্র খুলে বসেছেন। কাজ করছেন কৃষির ভার্টিক্যাল এক্সপানশনের।
ছাদকৃষি কার্যক্রমটিকে দেশব্যাপী প্রসারের জন্য নানান প্রযুক্তির সন্ধান দিচ্ছেন। আমি মনে করি আমাদের ছাদকৃষি অভিযানের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের মাইলফলক। যারা নতুন করে বাড়ি তৈরি করবেন তারা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ছাদকৃষির উপযোগী করে ছাদটিকে গড়ে নিতে পারেন। যাদের নিজস্ব বাড়ি নেই, তারা বারান্দায় কিংবা বাড়ির মালিকের অনুমতি নিয়ে ছাদকৃষি শুরু করতে পারেন। শুধু ঢাকায় নয়, আমি দেখেছি অন্যান্য শহরেও ছাদকৃষি নিয়ে মানুষের গভীর আগ্রহ। শহরের দূষণ কমাতে, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে ছাদকৃষি হতে পারে মোক্ষম কর্মসূচি। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু নীতিগত ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন বাড়ি তৈরি করার ক্ষেত্রে রাজউক থেকে নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও একটি নির্দিষ্ট অংশে সবুজের আয়োজন রাখা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এই ছাদকৃষি কার্যক্রম নতুন নতুন উদ্যোমে প্রসার লাভ করবে। সবাই তাদের ছাদটিকে সবুজ করে তুলবেন। আমি আশা করি, সেই দিনটি দূরে নয়, যেদিন ঢাকাসহ দেশের সব শহর-নগরেই সবুজ একটি স্তর তৈরি হয়ে যাবে। তখন উপর থেকেও সবুজ-শ্যামল কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে চেনা যাবে। সূত্র: বিপি
লেখক: শাইখ সিরাজ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন