অলস তিতিরে লাভ বেশি

80

 

শোভাবর্ধনকারী হলেও তিতির পালন বেশ লাভজনক। আজকের আয়োজন পাখিটির বিভিন্ন দিক নিয়ে । পোলট্রির বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে তিতির একটি। বাংলাদেশে পাখিটি কিছুটা অপিরিচিত, কারণ এটি সব সময় দেখা যায় না।

তিতিরের উৎপত্তি আফ্রিকায়। প্রায় ৭০০ বছর আগে বন-জঙ্গল থেকে গৃহপালিত মুরগি হিসেবে প্রাধান্য পায়। এটি সাধারণত পাখি হিসেবেই বিবেচিত ছিল। কিন্তু এটি তুলনামূলক বড় ও এর মাংস সুস্বাদু হওয়ায় একে মুরগির কাতারে নিয়ে আসা হয়। এর পর থেকে চীনা মুরগি বা চায়না মুরগি নামে এটি পরিচিতি লাভ করে।

প্রাচীন কালে গ্রিক ও রোমানদের সুস্বাদু খাদ্য ছিল তিতির। সুস্বাদু মাংস ও ডিমের জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ চীনা মুরগি। তিতির প্রথম দিকে যখন গৃহপালিত পশুপাখির তালিকায় স্থান করে নেয়, সেই সময় বাণিজ্যিক পোলট্রির দাপট তেমন একটা ছিল না। শখের বশে অনেকে তিতির পাখি পালতে শুরু করে। এরপর গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস-মুরগির সঙ্গে পালন করা হয়। ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফল হয়ে ওঠে তিতির পালন।

তিতির গৃহপালিত হওয়ার পরও এদের স্বভাব তেমন পরিবর্তিত হয়নি। বনজঙ্গলে তারা অলসতায় দিন কাটিয়েছে, গৃহে এসেও সেই অলসতা দূর করতে পারেনি। সুযোগ পেলেই জঙ্গলে বা ঝোপঝাড়ে পালিয়ে যায়। বাচ্চাদের তেমন খেয়াল রাখতে পারে না। এদিক থেকে স্বার্থপর মুরগিও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে তিতির পালনের জন্য বেশ কিছু খামার গড়ে উঠেছে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পাখিটি।

গবেষকরা তিতিরের তিনটি প্রজাতি খুঁজে পেয়েছেন। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৪ সেন্টিমিটার, ডানা ১৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট দুই দশমিক চার সেন্টিমিটার, পা চার দশমিক আট সেন্টিমিটার ও লেজ ১০ সেন্টিমিটার। পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরের চেহারা ভিন্ন হয়। তিতিরের বাচ্চা দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও পরিপূর্ণ বয়সে বদলে যায় আকৃতি ও চেহারা। একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে তিতির। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ, শস্যদানা, কচি কাণ্ড, ফল ও পোকামাকড়। ভোর ও সন্ধ্যায় এরা বেশি কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। এ সময় স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষè স্বরে ডাকে চিক… চিক… চিক… ক্রেকেক।

গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমণ বা পরজীবী তিতিরকে সহজে আক্রমণ করতে পারে না। ফলে খামারে তিতির পালন করতে আলাদা কোনো ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধের প্রয়োজন হয় না। প্রতিকূলতার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে মুরগি চলতে না পারলেও তিতির চলতে পারে। বছরে একটি তিতির ১০০ থেকে ১২০টি ডিম দেয়। ডিমগুলো হলদে জলপাই থেকে হালকা জলপাই বাদামি বর্ণের হয়। তিতিরের খামার গড়তে পারলে সফলতার মুখ দেখা সম্ভব।

# একটি আদর্শ তিতির খামার গড়ে তুলতে খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয় না
#স অন্যান্য পাখির তুলনায় এর রোগবালাই কম। কিছু নিয়ম মেনে চললে খামারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়
# খাবারের খরচ কম
# বাজারে এর চাহিদা রয়েছে
# উচ্চ মূল্য থাকায় খরচের তুলনায় আয় অনেক বেশি হয়।

একনজরে
# তিতিরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অন্য পাখির তুলনায় বেশি
# কৃমি কিংবা ছোঁয়াচে রোগ এদেরকে সহজে আক্রমণ করে না
# কচি ঘাস খেয়ে থাকে বলে এদের খাবার খরচ তুলনামূলক কম
# দৈনিক খাবার গ্রহণের পরিমাণ ১১০ থেকে ১২০ গ্রাম
#স যে কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে
# মাইকোটক্সিন ও আফলাটক্সিনের প্রতি অধিক সহনশীল
# ডিমের খোসা অত্যন্ত শক্ত
# বছরে ১০০ থেকে ১২০টি ডিম দেয়
# মাংস পুষ্টিকর ও সুস্বাদু

জাত
# পার্ল: ধুসর বর্ণের, সাদা স্পট থাকে
# লেভেন্ডার: হালকা ধূসর বর্ণের। সাদা দাগ রয়েছে
#হোয়াইট ভ্যারাইটি: সাদা রঙের পালক রয়েছে

জেনেটিক বৈশিষ্ট্য
# ডিমের ওজন ৩৫ থেকে ৪৫ গ্রাম
# হ্যাচাবিলিটি ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ
# দৈহিক ওজন ১.৬ থেকে ১.৭ কেজি
# ডিমে তা দেওয়ার প্রয়োজনীয় সময় ২৮ দিন
# এক দিনের বাচ্চার গড় ওজন ২০ থেকে ৩০ গ্রাম

অসুবিধা
# তিতিরের বাচ্চা ঠাণ্ডায় অধিক সংবেদনশীল হওয়ায় প্রথম সপ্তাহে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। সাধারণত প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন
# মা পাখি ডিমে ভালোভাবে তা দিতে পারে না
# মা পাখি বোকা স্বভাবের। বাচ্চার প্রতি উদাসীন। তাই প্রতিকূল পরিবেশে বাচ্চারা প্রাকৃতিক উপায়ে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে না
# শেয়াল, কুকুর, চিল, ঈগল প্রভৃতি থেকে তার বাচ্চাকে রক্ষা করতে খুব বেশি তৎপর নয় মা পাখি।

সমাধান
কৃত্রিম উপায় বা দেশি মুরগির সাহায্যে ডিম ফোটানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তিতিরের জাত

তিতিরের তিনটি জাত রয়েছে। এ তিন জাতের মধ্যে একটি জাত বাংলাদেশে দেখা যায়। তিন জাতের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।

পার্ল ভ্যারাইটি বা কালো তিতির
পার্ল ভ্যারাইটি বা কালো তিতিরের প্রধান আবাসস্থল বাংলাদেশ। এছাড়া নেপাল, ভারত, ভুটান প্রভৃতি স্থানেও দেখা যায়। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর উত্তর প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে এ মুরগিকে তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। তবে কমবেশি দেশের সবখানে পাওয়া যায়। এ ধরনের তিতির কালচে বাদামি রঙের হয়ে থাকে। এদের পালকে ফোঁটা ফোঁটা সাদা দাগ থাকে। দেখতে খুব আকর্ষণীয় হওয়ায় এদের পালকগুলো সৌন্দর্যবর্ধনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরের চেহারা ভিন্ন। পুরুষ তিতিরের পিঠ ঘন কালো। স্ত্রী তিতিরের পিঠ বাদামি ও মেটে বর্ণের। তবে পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরÑউভয়ের চোখ বাদামি। এসব মুরগির ঠোঁট কালো। প্রজনন মৌসুমে পা ও পায়ের পাতা গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে। এ জাতের তিতির ঘাস, ক্ষেত-খামার, চা বাগান ও পানির ধারের ছোট ঝোপে বিচরণ করতে ভালোবাসে। ঘাস, বীজ, আগাছা, শস্যদানা, কচি কাণ্ড, ফল ও পোকামাকড় এদের খাবার। মার্চ থেকে অক্টোবর কালো তিতিরের প্রজনন মৌসুম।

লেভেনডার ভ্যারাইটি
বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পার্ল ভ্যারাইটির সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায় লেভেনডারের। তবে এর পালকের রং হালকা ধূসর বর্ণের। বাকি সব একই। কিন্তু এ জাতটি বাংলাদেশে তেমন একটা পরিচিত নয় বা দেখা যায় না।

হোয়াইট বা সাদা ভ্যারাইটি
এ জাতের তিতির একেবার সাদা। এদের পালকে কোনো দাগ থাকে না। এ জাতটিও বাংলাদেশে দেখা যায় না।

পালন পদ্ধতি বেশ সহজ
একসঙ্গে তিতির, হাঁস ও মুরগি পালন করা যায়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার করতে চাইলে এর পালন পদ্ধতিটা ভিন্ন হবে। এ পাখি পালনে বাড়তি যত্ননিতে হবে।
খাঁচা বা ঘর: বাড়িতে তিতির পালনের জন্য প্রথমে উপযুক্ত খাঁচা বা ঘর তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। খাঁচার থেকে ঘর উত্তম। ঘর তৈরির জন্য বাঁশ, বেত, টিন, ছন, খড় প্রভৃতি ব্যবহার করতে হবে। ঘরের বেড়া বাঁশ দিয়ে ও দরজা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করতে হবে। চাইলে মাটির দেয়াল দিয়েও তৈরি করা যায় ঘর। বেড়া বা দেওয়ালে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য অবশ্যই ছিদ্র রাখতে হবে। তিতির খোলামেলা পরিবেশেও পালন করা যায়। তবে এর ঘর বা খাঁচা তৈরির আগে দেখে নিতে হবে বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড় বা জঙ্গল আছে কি না। ঝোপঝাড়ের পাশেই এদের ঘর তৈরি করা উচিত। কারণ এরা বাচ্চা ফোটানোর পর ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়াতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
জাত বাছাই: ঘর তৈরি হয়ে গেলে তিতিরের জাত বাছাই করে ঘরে তুলতে হবে। বর্তমানে তিতিরের তিনটি জাত রয়েছেÑপার্ল ভ্যারাইটি, লেভেনডার ভ্যারাইটি ও হোয়াইট ভ্যারাইটি। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে পার্ল ভ্যারাইটি জাতটি পালন করা সহজ। তাই এ জাতটি বেছে নিতে হবে।
পালনের সঠিক সময়: তিতির পালনের জন্য সাধারণত তেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় ধরাবাঁধা নেই। ইচ্ছা করলে বছরের যে কোনো সময়ে পালন করা যেতে পারে। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিতিরের প্রজনন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময় পালন করা উত্তম। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে যে পার্ল ভ্যারাইটি জাতটি পালন করা অত্যন্ত সহজ। তিতিরের ডিম দেশি-মুরগির মাধ্যমে ফোটানো যায়। তিতিরকে মূলত তিন অবস্থায় পালন করা যায়। প্রথমত, মুক্ত অবস্থায়। দ্বিতীয়ত, অর্ধ মুক্ত অবস্থায়। তৃতীয়ত, বন্ধ অবস্থায়।
এক একর জমিতে ৩০০ থেকে ৩৫০ টি পূর্ণ বয়স্ক তিতির পালন করা যায়। বাড়িতে তিতির পালন করা তেমন কঠিন নয়। তবে পালনের জন্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। একেকটির জন্য প্রতি তিন থেকে চার বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। ঘরের মেঝেতে পালনের সময় পাটের বস্তা ব্যবহার করতে হবে। অথবা শুকনো বালু ব্যবহার করা যেতে পারে। তিতির মুরগি সাধারণত ২৪ থেকে ২৬ সপ্তাহ বয়সে অর্থাৎ ছয়মাস বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। কিছু তিতির পাঁচ মাস বয়সেও ডিম দেয়। তিতিরের বাচ্চা সাধারণত মুরগির বাচ্চার চেয়ে একটু বেশি ঠাণ্ডায় অধিক সংবেদনশীল। তাই তিতিরের বাচ্চাকে প্রথম সপ্তাহে ব্রুডারে একটু বেশি তাপমাত্রায় রাখতে হবে। তিতিরের বাচ্চা একটু বড় হলে ব্রুডারের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। তিতিরের ক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, এটি বেশ অলস জাতের পাখি। এরা নিজেদের ডিমে বেশি ওম দেয় না। দেখা যায়, যদি ওম দেয় তবে দুই একটি বাচ্চা ফুটলেই এরা উঠে চলে যায়। তাই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর সময়ে বেশ সতর্ক থাকতে হবে।
তিতিরের ডিমের রঙ দেখতে অনেক সুন্দর। ডিম সাধারণত শক্ত হয়। বাচ্চা ফুটানোর পর নিয়মিত যতœ নিতে হবে। যেহেতু মা অলস তাই বাচ্চার যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব খামারিকে নিতে হবে। তা না হলে বাচ্চা মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

রোগবালাই
তিতিরের রোগবালাই তুলনামূলক কম। কিন্তু বাড়িতে তিতির পালন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা উচিত। নতুবা আক্রান্ত হতে পারে পাখিটি।
# গোল কৃমি হলে তিতির পাতলা মল ত্যাগ করে। এ রোগের কারণে ডিম দেওয়া কমে যায়
# মাঝেমধ্যে রক্ত আমাশয় দেখা যায়। আমাশয় হলে রক্তমিশ্রিত মলত্যাগ করে। এতে ওজন কমে যায়। মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়
# ট্রাইকোমোনিয়াসিস নামের এক ধরনের রোগ দেখা যায়। এ রোগ হলে মুরগির ঝুটি কালো হয়ে যায়। মুখ থেকে লালা ঝরতে শুরু করে। ওজনও কমে যায়
# তিতিরের গায়ে উকুন হয়। বেশি দেখা দিলে তিতির তার শরীর সারাক্ষণই চুলকাতে থাকে, এতে ঘা হতে পারে। লাল লাল ফুসকুড়িও উঠতে দেখা যায়।

সাবধানতা
অবশ্যই টিকা দিতে হবে। এছাড়া পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। অবহেলা করলে তিতির মারাও যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, অসুস্থ তিতিরকে যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ তিতির থেকে আলাদা রাখতে হবে। তা না হলে অসুস্থ তিতিরের সংস্পর্শে বাকিরাও আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া তিতিরের বাচ্চা ডিম ফুটে বের হলে এদের পা খোঁড়া হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তাই নিয়মিত যতœ নিতে হবে। তবে তিতির পালনে একটাই সুবিধাÑএদের আলাদা কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।