ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার্থে সাগরে ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এতে আজ বৃহস্পতিবার ১২ অক্টোবর মধ্য রাত থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের জন্য নিষিদ্ধ থাকবে নদী ও সাগরে ইলিশ ধরা। এ সময় মাছ ধরা, পরিবহন, বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। কিন্তু সরকারের এ নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনও পর্যন্ত উপকূলে ভিড়েনি বাঁশখালীর ২ হাজারেরও অধিক মাছ ধরার ট্রলার। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম মৎস্য উপজেলা বাঁশখালীর ৯০ শতাংশ মাছ ধরার ট্রলার সাগরে অবস্থান করছে। এমনকি তাদের উপকূলে ফিরে আসার তেমন কোনো কার্যক্রমও দেখা যায়নি। অধিকাংশ জেলেদের দাবি, তারা এই নিষেধাজ্ঞা মানবেন না।
বুধবার সন্ধায় চট্টগ্রামের বৃহত্তম মৎস্য ঘাট বাঁশখালীর ফাঁড়ির মুখ, সরকার বাজার, খাটখালী ও ছনুয়া ঘাট ঘুরে দেখা যায়, ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার্থে ২২ দিন ইলিশ ধরায় যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা যেন এসব এলাকায় পড়েনি। অন্যান্য সময়ের মতো এখনও চলছে কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে কয়েকটা মাছ ধরার ট্রলার দেখলাম সাগরে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। ট্রলারে ভর্তি করছে বরফ। অন্যদিকে বরফকলগুলোও চলছে জমজমাট। এতে উপকূলে ভিড়তে দেখা যায়নি কোনো মাছ ধরার ট্রলার। এ বৃহত্তম মৎস্য উপজেলার ৯০ শতাংশ ট্রলার এখনও গভীর সাগরে মাছ ধরার জন্য অবস্থান করছে। এদিকে তাদের উপকূলে ফিরতে হবে যে বুধবার রাত ১২টার আগেই সেটাও ভুলে গেছেন জেলেরা।
জানা যায়, এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাঁশখালী উপজেলার ৬ হাজার ৩৪২ জন জেলেকে চাল দেয়া হবে। এতে প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে চাল পাবেন। এদিকে সেই চাল নির্ধারিত সময়ে বিতরণের দাবিও জানিয়েছেন জেলেরা। তবে অনেক জেলে অভিযোগ করে বলেন, যারা জেলে তারা এই চাল পান না। চেয়ারম্যান ও স্থানীয় মেম্বারদের ঘনিষ্ঠজনরা এই চাল পেয়ে থাকেন। অথচ সত্যিকারের জেলেরা এই পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। তবে কিছু জেলে সরকারের নিষেধাজ্ঞা মানতে রাজি থাকলেও পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে দিন কাটাবেন, সে চিন্তার চাপ রয়েছে তাদের চোখেমুখে।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলে ও ট্রলার মালিক জানান, ‘এই মৌসুমে সাগরে ইলিশ বলতে কিছুই পায়নি। সাগরে ইলিশ নাই বললেই চলে। অথচ এখন কিছু ইলিশ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা। এখন মনে হচ্ছে মরে যেতে হবে। অথচ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদের ওপর দাদন নিয়ে থাকি। দীর্ঘদিন ধরে সাগরে ইলিশ ধরা না পড়ায় এখন ওই টাকাও ফেরত দিতে পারছি না। তবে এরকম চললে আমরা জেলেদের না খেয়ে মরতে হবে। অন্যদিকে এই নিষেধাজ্ঞার সময় বাংলাদেশে ঢুুকে ভারতীয় জেলেরা অবাধে ইলিশ শিকার করেন। মনে হয় ভারতীয়দের সুযোগ দিতে এই নিষেধাজ্ঞা। তাই প্রাণ গেলে যাক তারপরও সাগরে মাছ ধরতে যাব। আমাদেরও জীবন আছে, পরিবার আছে, আমাদের তো বাঁচতে হবে।’
এ বিষয়ে এক ট্রলার মালিক জানান, ‘বন্ধের সময় সাগরে যেতে হলে বঙ্গোপসাগর এলাকায় সংশ্লিষ্টদের একটা নির্দিষ্ট ফি দিতে হয় আমাদের। এরপর রয়েছে নানা সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক ছেলেপেলে, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের কাছেও নির্দিষ্ট ফি দিতে হয় আমাদের। তাই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভয় নাই। টাকা দিলে নিষেধাজ্ঞা বলতে কিছু থাকে না।’
আব্দুর রহিম নামে এক জেলে বলেন, ‘এ মৌসুমে তেমন মাছ ধরা পড়েনি, তাই সব ঋণ পরিশোধ করতে পারিনি। তারপর ইলিশ ধরা ২২ দিন নিষেধ। তবে নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে যদি এনজিওর কিস্তির টাকা আদায় বন্ধ থাকত, তাহলে কিছুটা হলেও ভালো থাকতে পারতাম। আমরা এবার ভরা মৌসুমে ইলিশ কম থাকায় অনেকেই দেনার দায়ে জর্জরিত। এখন মাছ ধরাও বন্ধ হচ্ছে, সব মিলিয়ে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।’
বাঁশখালী বোট মালিক সমিতির নেতা ও ব্যবসায়ী আব্দুর শুক্কুর বলেন, ‘সাগরে ইলিশ বলতে কিছুই নাই। বর্তমানে যে ট্রলারগুলো সাগরে আছে, ওইগুলো ১০-১৫ দিন আগে গেছে। তবে মাছ না পাওয়ায় কিছু ট্রলার গভীর সাগরে অবস্থান করছে। এগুলোর আসতে একটু দেরি তো হবেই। তবে কিছু ট্রলার চলে আসছে। বাকিগুলো রাতের মধ্যে চলে আসবে।’
বাঁশখালী সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এইবারে কাউকে সুযোগ দেয়া হবে না। আমরা এ বিষয়ে জেলে, মালিক সমিতি ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বুধবার রাত ১২টার মধ্যে সব ট্রলারকে উপকূলে চলে আসতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারপরও যদি কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর হবো। এ ছাড়াও নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবার সর্বোচ্চ সজাগ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কোনো সুযোগ নাই।’