আবারো পেঁয়াজে আগুন লেগেছে

323

পেয়াজ-3-300x162

বাজারে গিয়ে রাজধানীর ক্রেতাদের এখন এক কেজি দেশি পেঁয়াজ ২২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর যেসব পেঁয়াজ মানুষ পছন্দ করে না বলে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতেন না, সেই চীন, মিসর ও তুরস্কের ঝাঁজহীন বড় বড় পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এ সময়ে পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৪০ টাকা। ফলে এখনকার এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম গত বছরের সাড়ে পাঁচ কেজির সমান।

পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে গড়পড়তা পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগে। কেউ যদি খুচরা বাজার থেকে এখন পাঁচ কেজি দেশি পেঁয়াজ কেনেন, তাহলে দাম পড়বে ১ হাজার ১০০ টাকা, যা দুই চুলার এক মাসের গ্যাস বিলের চেয়ে ১২৫ টাকা বেশি। আবার মোটামুটি এক মাসের বিদ্যুৎ বিলের সমান।

কেবল পেঁয়াজেই নয়, চলতি মাসে ঢাকায় সরু চালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা, মাঝারি ৩ থেকে ৪ টাকা ও মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ২ টাকার মতো বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩ থেকে ৪ টাকা। আটার কেজি ১ থেকে ২ টাকা বাড়তি। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ টাকা। ডিমের ডজন এখন ১০০-১০৫ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির গুজবে লবণ কিনতেও বাড়তি ব্যয় করে ফেলেছেন অনেকে।

দরিদ্র মানুষকে পেঁয়াজ কেনা বাদ দেওয়ার পর্যায়ে নিতে হয়েছে। অনেকে এখন পেঁয়াজের বদলে পেঁয়াজপাতা কিনছেন। নতুন মৌসুমের শুরুতে গোড়ায় ছোট ছোট পেঁয়াজসহ পেঁয়াজপাতা বিক্রি হচ্ছে। কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। অথচ আশা করা হয়েছিল, উড়োজাহাজে উড়িয়ে এনে সরবরাহ বাড়ালে দাম কমবে। বিপুল পরিমাণ আমদানির খবরে বাজারও সাড়া দিচ্ছিল। শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারে দাম কমছিল।

কিন্তু গত বুধবার থেকে বাজার আবার বেঁকে বসে। বাড়তে শুরু করে দেশি পেঁয়াজের দাম। অন্যদিকে শুক্রবার ও শনিবার বেড়ে যায় আমদানি করা পেঁয়াজের দামও।

দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, চীনা পেঁয়াজ ৯০-১০০ টাকা এবং মিসর ও তুরস্কের পেঁয়াজ ১১০-১১৫ টাকা দরে বিক্রির কথা জানান ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পাকিস্তানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানে (৫ কেজি করে কেনা যায়) গতকাল বিকেলে দেশি পেঁয়াজ ২০০ টাকা, মিসর ও তুরস্কের পেঁয়াজ ১১৫-১২০ টাকা এবং পাকিস্তানি পেঁয়াজ ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়।

ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও বড় শহরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে গতকাল দুপুরের পর মিয়ানমারের পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৬০ টাকা, রাজশাহীতে দেশি ২০০ ও বিদেশি ১৭০-১৮০ টাকা, খুলনায় দেশি পেঁয়াজ ১৯০-২০০ টাকা, বরিশালে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা, রংপুরে পেঁয়াজ ২৪০ টাকা, কুমিল্লায় ২২০ টাকা, ময়মনসিংহে দেশি ২০০ টাকা ও বিদেশি পেঁয়াজ ১৬০ কেজি দরে বিক্রি হয়েছে বলে জানান প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা।

হঠাৎ করে দাম আবার কেন বাড়ছে, তা জানতে শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারের চারজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলেন, চড়া দামের কারণে চাহিদা কমেছে ঠিকই, তারপরও দেশে দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার টন পেঁয়াজের সরবরাহ দরকার। আকাশপথে ১০ টন, ২০ টনের চালান বাজারে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না।

এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশি পেঁয়াজ শেষের পথে। পাবনায় শনিবার মণপ্রতি দর উঠেছে ৮ হাজার টাকা, কেজি ২০০ টাকা। সে তুলনায় এখনো ঢাকায় দাম কম। তিনি বলেন, আকাশপথে আমদানি খরচ অনেক বেশি। ফলে জাহাজে না এলে দাম কমবে না।

তথ্য অনুযায়ী, আকাশপথে তিন দিনে প্রায় ২৬০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যদিও স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন। আর এক দিন বন্ধ থাকার পরে গতকাল মিয়ানমার থেকে ৭৮০ টন পেঁয়াজ এসেছে বলে জানান আমাদের টেকনাফ প্রতিনিধি।

বাণিজ্যমন্ত্রী গতকাল এক অনুষ্ঠান শেষে পেঁয়াজ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বছরের এ সময়টায় প্রতি মাসে এক লাখ টন করে পেঁয়াজ আমদানি হতো। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে আমদানি হয়েছে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টন করে। ফলে স্বাভাবিক আমদানির চেয়ে কম হয়েছে ৭৫ হাজার টনের মতো। তিনি বলেন, মিসর থেকে উড়োজাহাজে আমদানি করতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ২০০ টাকার বেশি পড়ছে। ওই পেঁয়াজ সরকার ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, তারা ঢাকার ৫০টি জায়গায় ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এ ছাড়া বিভাগীয় শহর ও কয়েকটি জেলায় পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে সংস্থাটি।

ভারত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম মূল্য ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়। এর আগের দিন বাজারে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৫০ টাকার আশপাশে ছিল। এরপরের ধাক্কা আসে ২৯ সেপ্টেম্বর, ভারত রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এ ধাক্কায় পেঁয়াজের বাজার ১৫০ টাকা ছাড়ায়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর।

অবশ্য পেঁয়াজ সেখানে থেমে থাকেনি। দাম বাড়ছিল। নতুন করে আরেক দফা লাফ দিয়ে পেঁয়াজের দর প্রতি কেজি ২৫০ টাকায় ওঠে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানি বাড়াতে এস আলম, সিটি ও মেঘনা গ্রুপকে মাঠে নামিয়েছে একটু দেরি করে। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় বড় গ্রুপগুলোকে অনুরোধ করা হয় অক্টোবরের মাঝামাঝিতে। ফলে জাহাজে আসতে নভেম্বরের শেষ নাগাদ সময় লাগছে।

এ সময়ে সরকার আড়াই হাজার ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে এবং কয়েকজন আমদানিকারককে কারাদণ্ড দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, তবে সুফল মেলেনি। বরং কোনো কোনো আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতা এখন পেঁয়াজ বিক্রিই ছেড়ে দিয়েছেন।

ভারতীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানির বড় উৎস মহারাষ্ট্রের পাইকারি বাজারে গ্রীষ্ম মৌসুমের পেঁয়াজের গড় দাম ৭০ রুপি। ভারতের ইকোনমিক টাইমস জানাচ্ছে, বুধবার দেশটি ১ লাখ ২০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ফলে তারা শিগগিরই রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে না।

(সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, মানুষ এই বাড়তি ব্যয় সামাল দেয় কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে, বিনোদন বা পোশাক কেনার মতো খরচ কমিয়ে, অনেক সময় নিজের আয় বাড়ানোর সুযোগ থাকলে, সেটা বাড়িয়ে। নিম্ন আয়ের মানুষকে ঋণ করেও ব্যয় সামাল দিতে হয়। প্রথম আলোকে গতকাল তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতা ধারাবাহিক হলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যাবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ