করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে দেশে লকডাউনের কারণে প্রকৃতিতে দূষণ হ্রাস পেয়েছে অনেকাংশে। কল-কারখানা বন্ধ থাকায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেয়ে কমেছে বায়ু দূষণ; খাল-বিল, নদী-নালা এমনকি সমুদ্রেও কমেছে দূষণ। এর প্রভাবে কিছুটা হলেও ভারসাম্য ফিরেছে প্রকৃতিতে। জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রকৃতির নিজস্ব গতিতে বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। ফলে এ বছর প্রচুর ইলিশ উৎপাদনেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
করোনার কারণে এবার অবৈধ মাছ শিকার ছিল প্রায় বন্ধ। সমুদ্র দূষণমুক্ত থাকা, নদ-নদীতে ৬৬ দিন লঞ্চ বন্ধ থাকা ও অবৈধ মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণে থাকায় ইলিশ উৎপাদনের রেকর্ড ভেঙে এবার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। সূত্র জানায়, ২০১৯-২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরে সেই রেকর্ড ভেঙে এখন পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। ক্রমবর্ধমান ইলিশ উৎপাদনের এই প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ রয়েছে প্রথম স্থানে।
গত ৮ জুন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে মিঠাপানির মাছে বাংলাদেশ তার তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। বিশ্বে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এ বছর দেশে মাছ উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও নদীতে বৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরায় কোনো বাঁধা নেই। জেলারা বলছেন-এবার জালে ধরা পড়ছে বড় বড় ইলিশ।
বরিশালের আব্দুর রহিম নামে এক জেলে জানান, মাছ ভালোই মিলছে। কিন্তু দাম কম। যে মাছ গত বছর বিক্রি হইছে ১০০০ টাকায় তা এবার সাড়ে ৬০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকায়ও বিক্রি হয় না। বরিশালের পাইকারি বাজারেও খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা মিলেছে। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় গিয়েও দেখা যায় সেই চিত্র। এক কেজি একশ গ্রাম বা এক কেজি দুইশ গ্রামের ইলিশের ডাক উঠছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। কখনো এর চেয়ে কম বেশিও হয়ে থাকে বলে জানালের পাইকারি মাছ বিক্রেতা নাছির হোসেন। খুচরা বাজারে এগুলো বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা বা তার একটু বেশিতে।
মেরুলের এক খুচরা বিক্রেতা মো. ফজলু জানান, গত বছরের আগের বছর যে ইলিশ বিক্রি করছি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায় সে ইলিশ এখন বিক্রি করছি এক হাজার থেকে ১২’শ টাকায়।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়-তিন বছরে ইলিশের দাম কমেছে প্রায় দেড়শ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ১ কেজি বা তার ওপরে ইলিশ পাওয়া যেত মাত্র তিন শতাংশ, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পাঁচ শতাংশে। ২০১৯ সালে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছরে বড় ইলিশের প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশেরও বেশি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের এক মৎস্য ব্যবসায়ী ও নেতা জানান, আগামী ২০ জুলাই মাছ ধরতে সাগরে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি পেয়ে মাছ শিকারে নেমেছেন। আমরা মাছ শিকার না করতে পারলেও অবৈধভাবে বাংলাদেশের সীমানায় এসে মৎস্যদস্যুরা মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। এদিকে ভারতের গণমাধ্যম জানায়, সেখানে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে প্রচুর ইলিশ। পশ্চিমবঙ্গ, হাওড়া, হুগলি ও মুর্শিদাবাদে গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের দামও অনেক কম।
ইলিশ গবেষক ও মৎস্য বিজ্ঞানী চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ বছর নদীতে মাছের খাবার ভালো রয়েছে। সব স্থানের জলাশয়ে খাদ্য প্রচুর থাকায় ইলিশসহ সব মাছ দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। করোনাসহ সম্ভবত আম্ফানের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। এরকম দূষণমুক্ত পরিবেশ বহু বছর পরে লক্ষ করা গেছে। ইলিশ উৎপাদনে এ বছর পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
তবে এই গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বছর প্রশাসন করোনা প্রতিরোধে বেশি নজর দিচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু জেলে ও কিছু মৎস্য ব্যবসায়ী জাটকা নিধনে নেমেছেন। এটা রোধ করা না গেলে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
সূত্র: ইত্তেফাক
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২জুন২০