একান্তর ক্রমিক ফলধারণ (অলটারনেট বিয়ারিং) সমস্যা ও তার প্রতিকার

397

[su_slider source=”media: 4205,4206″ title=”no” pages=”no”] [/su_slider]

কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ: একান্তর ক্রমিক ফলধারণ সমস্যা বলতে ফলগাছে এক বছর ফল আসে অতঃপর পরের বছর ফল আসে না বা খুবই কম পরিমাণ আসে বা গাছের একপাশের ডালগুলো ফল আসে আবার পরের বছর গাছের অন্যপাশে বা এক বছর উপরের দিকে অন্য বছর নিচের দিকে ফল আসাকে বুঝায়। আমাদের দেশে সাধারণত আম গাছে এ সমস্যাটি সকল অঞ্চলে প্রকটাকারে দেখা যায়। আম ছাড়াও আপেল, নাশপাতি, এভোকাডো ফলেও এই সমস্যা হয়ে থাকে।

একান্তর ক্রমিক ফলধারণ (অলটারনেট বিয়ারিং) হওয়ার কারণসমূহ
ফলধারণ ক্ষমতা হ্রাসপাওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো দায়ি তা হলো, ফল ধরার জন্য ডালের বয়স কাঙ্ক্ষিত না হওয়া, সুষম সারের অভাব, গাছের ট্রেনিং ও প্রুনিং সময়মতো না করা, ফলগাছে শোষক পোকার ব্যাপক আক্রমণ, আবহাওয়াজনিত কারণ, শারীরবৃত্তীয় কারণ, অসময়ে সেচ প্রদান এসব উল্লেখযোগ্য। গবেষণায় দেখা যায়, ফলগাছে ফলধারণের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ফলধারি ডালের বয়স কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ মাস বয়স হওয়া দরকার তা না হলে গাছে ফল আসে না, এটা জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে যেমন: ল্যাংড়া আমের জন্য ৮ মাস বয়সি ডাল দরকার। আবার অনেক সময় দেখা যায়, আম সংগ্রহের পর বোঁটার অংশ গাছে লেগে থাকে এটা পরবর্তীতে ওই গাছে ফল আসতে বাধা প্রদান করে। মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুষম পুষ্টি থাকার অভাব বা কোনো কারণে যদি গাছ তা গ্রহণ করতে না পারে তাহলেও ফল আসতে বাধা সৃষ্টি হয়। ইউরিয়া সারের আধিক্যের ফলেও গাছে ফলধারণে বাধা হিসেবে কাজ করে। ট্রেনিং ও প্রুনিং যে কোনো ফলগাছের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাজ যা সময়মতো পরিচর্যায় না আনলে গাছে ফল ধারণ হয়না। অনেক সময় শোষক পোকার তীব্র আক্রমণে যা গাছের কচি ডগা, পাতা ও ডগার শীর্ষভাগ থেকে রস চুষে খায় ফলে গাছের শক্তি কমে যায়, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে গাছ ফল ধারণে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফল উৎপাদনের জন্য আবহাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আম ফলের জন্য সাধারণত মুকুল আসার সময় শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়া প্রয়োজন। আবার মুকুল থেকে আম বের হওয়ার জন্য শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া দরকার। তাছাড়া আমের মুকুল আসার পূর্বে ভারি বর্ষণ হলে মুকুল বের হওয়া ব্যাহত হয়। গাছে যদি কার্বনের পরিমাণ বেশি হয়ে যায় তাহলে গাছের ডাল মটমট করে ভেঙ্গে যায়, এ অবস্থায় গাছে মুকুল আসে না আবার নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হয়ে গাছের কান্ড, ডাল ও পাতা সবুজ নরম হয়; গাছের অঙ্গজ অংশ বৃদ্ধি পায় ফলে মুকুল আসে না তাই কার্বন ও নাইট্রোজেনের অনুপাতের তারতম্যের ফলে গাছে মুকুল আসে না। তাছাড়া গাছের হরমোনের প্রভাবে যেমন-সাইটোকাইনিন হরমোনের তুলনায় জিবরেলিন হরমোন বেশি হলে গাছে মুকুল আসেনা। মধ্য অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো সেচ দেওয়া যাবে না, কারণ এসময়ে মুকুল বের হয়। সেচ দিলে গাছ পানি পাওয়ার ফলে গাছ পুষ্টি গ্রহণ বেশি করে এর ফলে মুকুল বের না হয়ে বরং কচি পাতা বের হয়ে আসে।

একান্তর ক্রমিক ফলধারণ (অলটারনেট বিয়ারিং) সমস্যার ব্যবস্থাপনা
ফলগাছে একান্তর ক্রমিক ফলধারণ একটি গুরুতর সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে কৃষকভাইদের ফলগাছের প্রতি একটু বিশেষ পরিচর্যার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত নিয়মিত ও সঠিক পরিচর্যা, সময়মত হরমোন প্রয়োগ, ফুল ও ফল পাতলাকরণ, প্রয়োজন অনুসারে ধোঁয়া প্রয়োগ করা, বাকল ছাঁটাইকরণ, ফল সংগ্রহের পর ডাল ছাঁটাই এসব করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া প্রতিবছর ফলধারণ করে এমন জাতের ফলগাছ আবাদ করতে হবে। আমের জন্য যেমন আম্রপালি, হিমসাগর, বারোমাসি, রাণীপছন্দ, ফজলি, মল্লিকা, ক্ষিরসাপাতি এসব জাত নিয়মিত ফল দিয়ে থাকে। প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে বছরে কমপক্ষে মোট দু’বার ফলগাছের গোড়ার চারদিকে মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরি করে জৈবসারসহ রাসায়নিক সার দিতে হবে। গাছের গোড়ায় খরার সময় পরিমিত মাত্রায় সেচ প্রদান করা এবং বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবার ফলধারণের পর থেকেই নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে। ফলগাছে যদি প্রচুর ফুল ও ফল আসে তাহলে কিছু ফুল ও ফল ছিড়ে দিতে হবে। ফলগাছের সকল পরিচর্যা – অঙ্গছাঁটাই, প্রুনিং, মরা ডালপালা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, গাছের গোড়া পরিষ্কার করা, বালাইনাশক প্রদান- মুকুল আসার পূর্বে ধোঁয়া প্রদান এসব সঠিক সময়ে করতে হবে। আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যা হলো গাছে যদি ৫ থেকে ৭ বছর ধরে ফল না ধরে তাহলে এমন গাছের ক্ষেত্রে ১ বছর বয়স্ক ডালের গোড়ার দিকে বলয় আকারে বর্ষাকালে বাকল তুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছে হরমোন যেমন: ইথ্রেল, পটাশিয়াম নাইট্রেট ও অন্যান্য হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। পুষ্টি, বল, অর্থে ফলের তুলনা নাই। একান্তর ক্রমিক সমস্যায় প্রতিবছর কৃষকরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে প্রয়োজনিয় পুষ্টির। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে সহজেই এ সমস্যা সমাধানে কৃষকরা এগিয়ে আসলে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। পুষ্টি নিরাপত্তায় আরোও একধাপ এগিয়ে যাবে দেশ।