কমছে মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মীরকাদিমের গরুর উৎপাদন, ভবিষ্যতে টিকে থাকার শঙ্কা

801

মীর-কদমের-গরু

মুন্সীগঞ্জ থেকে: দেশের সৌখিন ও বনেদী পরিবারগুলোর কোরবানির জন্য সবসময়ই চাহিদা ছিল মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের গরুর। এই এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে মোটাতাজা করা গরুর প্রতি আকর্ষণ ছিল মানুষের। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে দৃশ্যপট। গরু পালনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক খামারি ও গরু ব্যবসায়ীই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে মীরকাদিমের গরুর সংখ্যা। মীরকাদিমের বাকি যারা এখনও গরু লালন-পালন করে চলেছেন তারাও কতদিন তা ধরে রাখতে পারবেন— তা নিয়েই শঙ্কা স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা বলছেন, মীরকাদিমের গরুর মধ্যে ধবল গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আর বুট্টি গরু, বাজা গাভী ছাড়াও নেপালি, মণ্ডি, হাঁসা, পশ্চিমা ও সিন্ধি জাতের গরুর জন্য কোরবানির ঈদ তো বটেই, সারাবছরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও মীরকাদিমের খামারিদের কদর ছিল। রাজধানী ঢাকাসহ মুন্সীগঞ্জের আশপাশের জেলার মানুষ ছুটে আসত মীরকাদিমে। দূর-দূরান্তের হাটেও যেত এসব গরু। আর এখনও পুরান ঢাকার নামিদামি অনেক পরিবারই মীরকাদিমের গরু কোরবানি দেওয়াকে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য মনে করেন।

স্থানীয়রা বলছেন, একটা সময় মীরকাদিমের প্রতিটি ঘরে ঘরে এসব বিশেষ জাতের গরু লালন-পালন হতো। এখানে ছিল তেলের ঘানি বা মিল, ধান-চালের মিল। খুব সস্তায় খৈল, ভূষি, খুদ, কুঁড়া ইত্যাদি পাওয়া যেত। তাতে লালন-পালনের পর গরু বিক্রির সময় ভালো লাভও থাকত খামারিদের পকেটে। তবে ক্রমেই গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই লাভের মুখ দেখাটা কঠিন হয়ে গেছে। ফলে গরু লালন-পালন ও মোটাতাজাকরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা। এখন হাতেগোনা কয়েকটি পরিবারই ধরে রেখেছে এই পেশা।

সরেজমিনে দেখা গেল, এ বছর মীরকাদিমে ঈদের হাটে গরু বিক্রির পরিমাণ কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, রাজধানীর হাটে মীরকাদিমের গরু বলে এখন যেগুলো বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই আসলে পাবনা বা সিরাজগঞ্জের গরু। তবে যারা কিছুটা সৌখিন এবং দেখতে আকর্ষণীয় গরু কোরবানি দিতে চান, ঈদের আগে এখনও তাদের আনাগোনা দেখা যায় এই অঞ্চলে।

কেন মীরকাদিমের গরুর এত সুনাম? জানা গেল, বিশেষ পালন কৌশলের কারণে এসব গরুর মাংস দারুণ সুস্বাদু হয়। ট্যাবলেট খাইয়ে বা কোনো ধরনের ইনজেকশনের মাধ্যমে এখানকার গরুগুলোকে স্বাস্থ্যবান করা হয় না। খৈল, ভূষি, খুদ ইত্যাদি প্রাকৃতিক খাবারেই বেড়ে ওঠে এখানকার গরু। এর সঙ্গে নেওয়া হয় বিশেষ যত্ন। আর তাতেই মোটাতাজা হয়ে ওঠে গরুগুলো। তাই এর দাম ও চাহিদা দু’টোই বেশি।

পরিমাণে কমলেও এখনও পুরনো ঢাকার রহমতগঞ্জসহ বড় বড় হাটগুলোতে দেখা মেলে মীরকাদিমের গরুর। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে পুরান ঢাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা ঈদের কয়েক মাস আগেই মীরকাদিমে চলে যান গরু কিনতে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু পছন্দ করে কিনে নেন। ঈদের আগ পর্যন্ত ওই গরুর লালন-পালনের দায়িত্বও থাকে গৃহস্থ বা খামারির ওপরই। তার জন্য দিয়ে আসেন প্রয়োজনীয় খরচ। ঈদের দুয়েকদিন আগে তা পৌঁছে যায় ক্রেতার বাড়িতে। এই প্রক্রিয়ায় কোরবানির হাটে ওঠার আগেই অনেক গরু বিক্রি হয়ে যায়।

গরু পালনকারীরা জানান, মীরকাদিমের গরুর চাহিদা অনেক। কোরবানির ঈদের ৬-৭ মাস আগেই তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট ও বাছাই করা গরু কিনে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে বাজা গাভী, খাটো জাতের বুট্টি গরু, নেপালি, সিন্ধি জাতের গরু আনা হয়। তবে এ গরুগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে— এগুলোর বেশিরভাগের গায়ের রঙ সাদা ও নিখাদ হয়। একেকটি গরুর দাম পড়ে ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। পরের ছয় থেকে সাত মাস চলে মোটাতাজা করার কাজ। এই প্রক্রিয়ায় গরুর খাবারের পেছনেই খরচ হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে নিতে হয় বাড়তি যত্ন। এত পরিশ্রম আর খরচের পর এখন একেকটি গরু যে দামে বিক্রি করতে হয়, তাতে পোষায় না বলে অভিযোগ খামারিদের। তবু কেউ কেউ পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে টিকিয়ে রেখেছেন এই ব্যবসা।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বুট্টি গরু পাওয়া গেলেও মীরকাদিমের বুট্টি গরুর বৈশিষ্ট্য আলাদা। আকারে অনেক ছোট এই গরুর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় মাংসের স্বাদ কেমন হবে। এর বাহ্যিক অবয়ব খুব তেলতেলে ও গোলাকৃতির। মাংস হয় মোলায়েম ও সুস্বাদু। এছাড়া নেপালি গরু হয় মাঝারি উচ্চতার। মণ্ডি, সিন্ধি অনেক রঙের হলেও পশ্চিমা আর হাঁসা গরু সাদা রঙের। সাদা এসব গরুর উচ্চতাই সবচেয়ে বেশি। গরুর হাটের আকর্ষণ বাড়াতে এসব গরুর চাহিদা বেশ। এর মধ্যে সিন্ধি গরুর চাহিদা তো বিশ্বব্যাপী।

কিন্তু বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, গরু মোটাতাজাকরণে প্রচুর লোকসান হয়। কসাইরা যে দামে গরু কেনে, হাটে উঠেলে তার চেয়েও কম দাম পাওয়া যায়। ক্রমাগত লোকসান আর আর্থিক অসঙ্গতির কারণে এ ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন পালনকারীরা। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মীরকাদিমে গরু মোটাতাজা করার কাজে আর কাউকে পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বললেন, আমরা এখন গরু পালন করে লাভ করতে পারি না। গতবছরও আমার দুই লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

আরেক গরু চাষি বলেন, পাবনা-সিরাজগঞ্জের গরু বাজারে ওঠার পর থেকে আমরা গরুর দাম পাচ্ছি না। ওদের খরচ কম হয় বলে কম দামে গরু বিক্রি করে। কিন্তু সেই দামের সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না।

জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুরাইয়া জাহান জানান, চাহিদা থাকলেও ধবল গরুর সংখ্যা কমছে। তবে এই গরুর চাহিদা থাকায় আমরা সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে চাষিদের গরু পালনে সহায়তা করছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পরামর্শ, সেবা ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে আবার গরু লালন-পালনের আগ্রহ তৈরিতে কাজ করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।’ এই প্রজাতি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উপজেলা পরিষদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসবি

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন