কৃষিতে বাড়ছে নারী উদ্যোক্তা

17

বহুজাতিক কোম্পানিসহ তথাকথিত আধুনিকায়নের করাল গ্রাসে আমাদের কৃষির অনুষঙ্গগুলো একে একে নষ্টের পথে। বীজ থেকে সার, সেচ এমনকি বীজের ক্রয় ও বিক্রয় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তাদের নির্ধারিত ব্যবস্থায়। এমন অবস্থায় শঙ্কাকে পাশ কাটিয়ে কৃষিতে হাত লাগাচ্ছেন নারী। নারীর অধিকার বা চাকরিতে সম-অধিকারের কথা বেশ পুরোনো। কৃষিতে একটা সময় প্রান্তিক নারীরা ছিলেন দিনমজুর মাত্র। এখন নারীরা কৃষি উদ্যোক্তা। তারা সার থেকে ফসল, খামার থেকে বিপণন সবই করছেন নিজ হাতে। যদিও তথ্য বলছে, কৃষির বেশিরভাগ ছোট-বড় সুযোগ-সুবিধা এখনও চলে পুরুষকেন্দ্রিকভাবে, তবুও কৃষিতে নারী উদ্যোক্তার হার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি সুযোগ-সুবিধার অর্ধেক অংশও যদি নারীকেন্দ্রিক বরাদ্দ হয়, তাহলে প্রান্তিক এই কৃষি অর্থনীতির জাতীয় অর্থনীতির চাকায় শামিল হতে সময় লাগবে না।

ফাতেমা বেগম। বয়স ৫৫ বছর। চার বছর বোনের কাছে টাকা ধার করে একটা ক্রস জাতের ফ্রিজিয়ান গাভি কিনেছিলেন এক লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। সেই গাভীর দুধ ও গোবর সবই তার পণ্য। ক্রেতারা আগাম টাকা দিয়ে যান। এখন ওই এক গরুর বাচ্চা থেকে তার ছয়টি গরু। বিক্রি করেছেন দুটি। এক লাখ ৩৫ হাজার টাকার পুঁজি এখন ১২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে চার বছরে। গরুর গোবর থেকে ভার্মিকম্পস্ট সার প্রস্তুত করছেন। এই সার প্রস্তুত করতে গিয়ে দেখছেন নতুন আলো। চিন্তায় এসেছে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের।

তিস্তাপাড়ের মোহসেনা আক্তার নীলা। বয়স ৩০ বছর। তার সঙ্গে আলাপ হয় তিস্তার গহিন চরে। মাথার ওপর সূর্য নিয়ে কাজ করছেন বাদাম ক্ষেতে। নীলা জানালেন, এবার চরে নিজের ও অন্যের জমিসহ মোট ১০ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেছেন। ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, বাদাম, মিষ্টিকুমড়া ও তামাক লাগিয়েছেন, ধান লাগিয়েছিলেন। ধান তুলে সেই জমিতে আলু লাগিয়েছিলেন। আলু তোলা শেষ। এখন সেই জমিতে শাক-সবজি লাগিয়েছেন। কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া প্রণোদনার বাদামের ফলনও হয়েছে বেশ।

নীলা বলেন, এবার বর্ষার শেষে সিকিমের বাঁধ ভেঙে যে বন্যা হলো, সেই বন্যার পরে তার জমিগুলোয় কালো রঙের পলির আস্তরণ পড়েছে। সেই পলিযুক্ত বালিতে যা-ই লাগাচ্ছেন, সেই ফসলই বাম্পার ফলন দিচ্ছে। এমন পলিযুক্ত চর তার সারাজীবনে দেখেননি। আর পলিতে যে এত ভালো ফলন হয় সার পানির কম খরচে, তাও জানা ছিল না। এবারের চাষাবাদে সে আসার আলো দেখছেন। আধুনিক কৃষিসেবা পেলে এক জমিতে এরকমভাবে কয়েক রকম ফসল ফলানো যায়। এই চাষাবাদ তিনি চালিয়ে যেতে চান, দাবি শুধু সঠিক পরামর্শের।

হালিমা বেগমের বয়স ২৮ বছর। কৃষি বিভাগ তার শ্বশুরকে দুটি রিং ও ২৫০ গ্রাম কেঁচো দেয়। হালিমার শ্বশুর নিজের জমির জন্য ভার্মিকম্পোষ্ট বা কেঁচো সার তৈরি করছিলেন খুবই ছোট করে। ভার্মি কম্পোষ্ট সার প্রয়োগে হালিমার বাড়িতে লাগানো শাকসবজির ফলন বাড়ে আশার চেয়ে বেশি। হালিমা তার শ্বশুরের কাছ থেকে কেঁচো চেয়ে নেন। শুরু করেন ছোট করে ভার্মিকম্পস্ট সার উৎপাদন। এখন দুই ফুট বাই ১০ ফুটের ১০টি হাউসে ভার্মিকম্পোষ্ট উৎপাদন করছেন এবং ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এর এতটাই চাহিদা যে পূরণ করতে পারছেন না। হালিমার সার উৎপাদনে ১০ শ্রমিক কাজ করেন। তিনি জানালেন, গত মাসে ৩০০ টন সারের অর্ডার পেয়েছেন। এত চাহিদার বিপরীতে তার উৎপাদন কম। তিনি উৎপাদন বাড়াচ্ছেন। নতুন ঘরের পাশাপাশি হাউস তৈরি করছেন।

মিনতী রানী দক্ষিণ ভোটমারি গ্রামের তিস্তার চরে প্রতি বছর রবিশস্য চাষাবাদ করেন। এক বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেছেন। প্রতি বছর এক বিঘা জমিতে ৯০ থেকে ১০০ মণ মিষ্টিকুমড়ার ফলন হয়। এবার পলি পড়ায় ফলন বেড়েছে। প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়া স্থানীয় বাজারে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। প্রতিবছর বাইরে ফুড কোম্পানিগুলো এই চর থেকে মিষ্টিকুমড়া কিনে নিয়ে যায়। এবার আসেনি। ১৫ টাকা কেজি দরে এক বিঘায় ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন। বাইরের কোম্পানিগুলো ৪০ টাকা কেজি পর্যন্ত কিনে নেয়। ভাগ্য ভালো থাকলে বাইরের কোম্পানি আসবে। তখন ৪০ টাকা দরে এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় তার কুমড়া বেচতে পারবেন বলে আশা করেন।

কালিগঞ্জ কৃষি দপ্তর বলছে, রংপুর বিভাগ কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ভোটমারী ইউনিয়নে ১০টি কৃষক গ্রুপ রয়েছে, যা ওই প্রকল্পের অর্থায়নে চরের অনাবাদি পতিত জমিতে মিষ্টিকুমড়া আবাদ উদ্বুদ্ধ করে বীজ ও সার দিয়ে সহায়তা করছে। এতে পতিত জমিতে মিষ্টিকুমড়া আবাদ করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

খামারি ও কৃষকরা জানান, এই খামার ও কৃষিকে প্রকল্প আকারে সাজাতে বড় বড় বাধা অতিক্রম করতে হয়। সহজ শর্তে কোনো কিছুই মেলে না। সরকারি ভর্তুকিও নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। প্রাণীর খাবার থেকে শুরু করে জমির সার-বীজ সব স্থানে সিন্ডিকেটের কবলে পড়তে হয়।

খামার নিয়ে কাজ করা একাধিক সূত্র বলছে, খামারি বা কৃষিতে লাভবান হতে হলে বাইপ্রডাক্টের দিকে নজর দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে আচার তৈরিসহ নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। খামারিরা তাদের নিজের খামারে বায়োগ্যাস, ভার্মিকম্পস্ট, দই ও ছানার মতো প্রডাক্ট খুব সহজে করতে পারেন। এক জমিতে একাধিক ফসল আর এক ফসলেই একাধিক ভোগ্যপণ্য তৈরি সম্ভব। এ বিষয়ে দপ্তরগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গির আলম বলেন, আলাদা করে নারী খামারির তালিকা করা হয় না। নারী খামারিদের জন্য প্রতি উপজেলায় প্রাণিসম্পদ দপ্তর কাজ করছে, যাতে নারী খামারিরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাইপ্রডাক্ট করতে পারে, সে বিষয়ে যাবতীয় কারিগরি সহযোগিতা করা যায়।

জেলা কৃষি দপ্তরের উপ-পরিচালক ড.সাইখুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষিপণ্য বিপণনের জন্য কাজ করার কথা। আমি খোঁজ নেব বাইরের কোম্পানিগুলো এবার কেন আসেনি। আমরা নারী কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি। মাশরুমের উদ্যোক্তা তৈরি করছি। এই জেলায় আমি নতুন। কোম্পানিগুলো আচারশিল্প, মাশরুমসহ নারী কৃষকদের সঙ্গে যেন কাজ করে, সে বিষয়ে আমি সবার সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা করব।’