কৃষি দিয়েই দূর করুণ দারিদ্রতাকে

794

Untitled-1-copy-1812151118

বকুল হাসান খাঁন
গ্রাম অথবা শহর, সেখানেই বসবাস করিনা কেন, আমাদের বসত বাড়ির আশে পাশে বা বাড়ির আঙ্গিনায় যদি অল্প খালি জায়গা থাকে, এবং সেখানে আলো বাতাস চলাচল করে, তাহলে খুব সহজেই আমরা শাক সবজি চাষ এবং হাঁস-মুরগী পালনের মতো লাভজনক কাজ করে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে। তাছাড়া পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পর বাড়তি আয় দিয়ে পরিবারের স্বচ্ছলতা এবং ছেলে- মেয়েদের লেখাপাড়ার খরচ মেটানো যেতে পারে। যে সব দরিদ্র মহিলার নিজের সামান্য বসতভিটেও নেই, অথবা অন্যের বাড়িতে বসবাস করতে হয়, তারাও ইচ্ছা করলে সামান্য পুঁজি খাঁটিয়ে কৃষি অথবা কৃষি বহির্ভূত কার্যক্রম, যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এতে নিজেদের উপার্জন দিয়ে পরিবারের অভাব দূর করে স্বাবলম্বি হওয়া যায়। পারিবারিক অভাব বা দারিদ্র দূর করার লক্ষ্যে সবজি চাষ, হাঁস-মুরগী পালন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা বিষয়ক কিছু তথ্যাদি এখানে উপস্থাপন করা হলো।

সবজি চাষের গুরুত্ব: পতিত জমি ব্যবহার করা যায় । পরিবারের দৈনন্দিন সবজির চাহিদা পূরণ ও পুষ্টির অভাব দূর হয়। বাড়তি আয় হয় ও সবজি কেনায় খরচ বাচেঁ। নিয়মিত টাটকা সবজি খাওয়া যায়।

গ্রীষ্মকালীন সবজি: গ্রীষ্মকালে চাষ হয় এমন শাক সবজির মধ্যে অন্যতম হলো-ডাঁটা, পুই, কলমী, থানকুনি, হেলেঞ্চা, কাঁচকলা, পটল, ঢেঁড়স, ঝিঙা, চিচাঙ্গা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, সজিনা, করলা, শসা, মুখীকচু, বেগুন, ওলকচু এসব।

শীতকালীন সবজি: লালশাক, পালংশাক, সরিষাশাক, ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রোকলি, টম্যাটো, লাউ, সীম, মুলা, গাজর, শালগম, লেটুস এসব।

শাক সবজি উৎপাদনের সময় ও কৌশল: গ্রীষ্মকালীন শাক সবজি ফাল্গুন- চৈত্র মাস থেকে শুরু করে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চাষ করা যায়। তবে আগাম চাষ করতে পারলে বেশি মূল্য পাওয়া যায়। আশ্বিন-কার্তিক মাস শীতকালীন শাক সবজি চাষের উপযুক্ত সময়।

জমি নির্বাচন: আলো বাতাস চলাচলের সুবিধা, সেচের সুবিধা, অতিবৃষ্টির সময় জমি থেকে পানি বের করার সুবিধাযুক্ত উর্বর দোঁয়াশ মাটি শাক সবজি চাষের জন্য ভাল।

জমি তৈরি: ভালোভাবে চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে করে জমি তৈরি করা প্রয়োজন। বেডে শাক সবজি চাষের ব্যবস্থা নিলে সেচ ও পরিচর্যায় সুবিধা হয়।

সার প্রয়োগ: পুরমাণমতো গোবর, টিএসপি, এমমি সার শেষ চাষের সময় ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়। ইউরিয়া সার চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পর প্রথম উপরি প্রয়োগ করতে হয়। দ্বিতীয়বার উপরি প্রয়োগ করতে হয় আরো ১৫ দিন পর। লাউ বা কুমড়া জাতীয় অন্যান্য সবজির বেলায় মাদা তৈরি করে প্রতি করতে মাদায় গোবর-১৫ কেজি, সরিষার খৈল-৫০০ গ্রাম, ইউরিয়া-২৫০ গ্রাম, টিএসপি-২৫০ গ্রাম এবং এমপি-২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়।

জৈব সার/কম্পোস্ট তৈরীর পদ্ধতি: ছায়াযুক্ত স্থানে একটি গর্ত করে গর্তের ভিতরে গোবর, খড়, ঘাস, লতা-পাতা, কচুরিপানা, হাঁসমুরগীর বিষ্ঠা, তরিতরকারির খোসা বা অবশিষ্টাংশ এবং প্রতিদিনের ময়লা আবর্জনা ফেলতে হবে। গর্তের আকার ৪ হাত লম্বা, ৪ হাত চওড়া ও ২ হাত গভীর হতে পারে। আবর্জনা ফেলার পর সামান্য ইউরিয়া এতে ছিটিয়ে দিলে এগুলো দ্রুত পঁচে যাবে। গর্ত ভরে গেলে গর্তের মুখ মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে এবং প্রয়োজনে এর উপর চালা তৈরি করা যেতে পারে। ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে আবর্জনা পঁচে ধুসর কালো রঙের জৈব সার তৈরি হয়।

বীজবপন/ চারা রোপণ: আধুনিক জাতের ফসলের ভালো বীজ জমিতে উপযুক্ত ‘জো’ অবস্থায় বপন করতে হয়। বীজ বপন ও চারা রোপণের কাজ বিকেলে করা ভালো।

পরিচর্যা: সবসময় আগাছা পরিস্কার করা, চারা ঘন হলে নিড়ানি দিয়ে পাতলা করা, লতানো গাছে বাউনি ও মাচা তৈরী করে দেয়া এবং নিয়মিত সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে চারার গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং প্রয়োহজনে জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া আইপিএম পদ্ধতিতে সময়মতো পোকা ও রোগদমনের ব্যবস্থা নিতে হয়।

ফসল সংগ্রহ: ফসল পরিপক্ক বা বাত্তি হলে অথবা বিক্রয় উপযোগী হলে শাক সবজি তুলতে হবে।

হাঁস-মুরগী পালন: বসত বাড়িতে মহিলারা সহজেই মুরগি পালন করতে পারেন। উন্নত জাতের মুরগি পালন করতে পারলে মাংস ও ডিম বেশি উৎপন্ন হয়। জাত ফাওমী, সোনালী ও রূপালী এখন জনপ্রিয় জাত।

পালন পদ্ধতি: মুরগি ছেড়ে অথবা আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা যায়। ঘরের মেঝে, খাঁচায় ও মাচায় মুরগি পালন করা যায়। বাজার থেকে অথবা ভালো খামার থেকে ব্রয়লার বা লেয়ার বাচ্চা কিনে এদের প্রতিষেধক টিকা দিয়ে পালন করতে লাভ বেশি হয়। কারণ, প্রাথমিক টিকার কারণে বাচ্চার মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে। অসুস্থ হলে মোরগ- মুরগিকে আলাদাভাবে রাখা প্রয়োজন। চিকিৎসকের পরামর্শমতো এর চিকিৎসা করা দরকার। শহর এবং গ্রাম সব জায়গায়ই হাঁস- মুরগির চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।

হাঁসের জাত: ডিম উৎপাদনের জন্য মুরগির পরই হাঁসের স্থান। ডিম ও মাংস উৎপাদনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জাতের হাঁস বেছে নিতে হয়। ডিম উৎপাদনের জন্য খাকি ক্যাম্পবল, ইণ্ডিয়ান রানার বেশ ভাল। ডিম ও মাংস উৎপাদনের জন্য দেশি হাঁস বেশ ভালো। আর মাংস উৎপাদনের জন্য বেজিং জাতের হাঁস উত্তম।

পালন পদ্ধতি: তিনটি উপায়ে হাঁস পালন করা যায়। (১) ছেড়ে খাওয়ানো পদ্ধতি, (২) অর্ধ আবদ্ধ পদ্ধতি, (৩) আবদ্ধ পদ্ধতি। তবে ছেড়ে খাওয়ানো পদ্ধতিই গ্রাম বাংলার জন্য উপযুক্ত। অর্ধ আবদ্ধ এবং আবদ্ধ পদ্ধতিগুলো খামার পর্যায়ে ভাল।

ছেড়ে খাওয়ানো পদ্ধতিঃ বাড়ির পাশে ডোবা, পুকুর অথবা বিলঝিল থাকলে সারাদিন হাঁস সেখানে চড়ে বেড়াতে পারে। মুক্ত জলশায় থেকে এরা প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সকালে এবং রাতে সামান্য খাবার দিলেই চলে। তাই কম খরচে দরিদ্র মহিলারা খুব সহজেই এভাবে হাঁস পালতে পারেন।

অর্ধ-আবদ্ধ পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে বসতবাড়ির আশপাশে সুবিধাজনক স্থানে হাঁসের থাকার জায়গা করতে হয়। মুক্ত জলশায় অথবা অনাবাদি জমির পাশে এ পদ্ধতিতে হাঁস পালন করা সহজ। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি হাঁসকে দৈনিক মাত্র ১৪০ গ্রাম খাবার দিলেই চলে।

আবদ্ধ পদ্ধতি: যাদের জায়গা কম, কাছাকাছি জলশায় নেই তারা আবদ্ধ পদ্ধতিতে হাঁস পালন করতে পারেন। এক্ষেত্রে হাঁসর ঘর ৭-৮ ফুট উঁচু হতে হবে। প্রতিটি হাঁসকে দৈনিক ১৬০ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে।

খাদ্য: চালের কুড়া, ভূষি, ঝিনুক চূর্ণ, ভাতের মাড়, শামুক, ধান, গম, ভুট্টাচূর্ণ, খনিজ লবণ এসব।

পরিচর্যা: হাঁসের খোয়াড় বা ঘর সবসময় পরিস্কার রাখতে হয়। ডিম পাড়া হাঁস খোয়াড় থেকে দেরিতে ছাড়তে হয়। হাঁসের রোগ তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। তকে কলেরা ও প্লেগ রোগে হাঁস বেশি আক্রান্ত হয়। তাই রোগ হবার আগেই টিকা দেবার ব্যবস্থা করা দরকার।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪ফেব্রু২০২০