ফুল দিয়ে মানব চিকিৎসা

1091

anatomical-paintings-nunzio-paci-fb6__700-png
বকুল হাসান খাঁন
ফুল কেনা ভালবাসে? সবাই। যে কোন ফুলের সৌন্দর্য মনের তৃষ্ণা মেটায়। পরিবেশকে সুন্দর করে মন প্রশান্তিতে ভরে দেয়। নিরন্তর ফুলের শোভা দেখে মনে হয় দীর্ঘ এক স্বপ্ন দেখতে দেখতে পার করে দেই ক্ষুদ্র এই পৃথিবীর জীবন। কিন্তু না। অপার্থিব অনুভূতির মত পার্থিব জীবন নয়। দেহের মধ্যে বাসা বাধে নানা রকম অসুখ বিসুখ। স্বপ্ন প্রশান্তি তখন ধীরে ধীরে ভাঙ্গতে শুরু করে। কোন কোন সময় সে অবস্থায় সুন্দর ফুল আর পৃথিবীকে কুৎসিত মনে হয়। কিন্তু ফুলের সৌন্দর্যের মত অনেক ফুল গাছের মধ্যেই রয়েছে আর এক মহা সুন্দর, তা হচ্ছে গাছের ভেষজ গুণ। এসব ফুলগাছ আঙিনায় রেখে একদিকে যেমন পেতে পারি স্বর্গের আনন্দ অন্যদিকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন পরিবেশ সম্মতভাবে সারিয়ে তুলতে পারি আমাদের অসুখগুলো। প্রাথমিক চিকিৎসা তো বটেই- ক্যান্সারের মত কঠিন রোগও সারিয়ে তুলতে পারি ফুল গাছ দিয়ে।

গাঁদা ফুল: হঠাৎ শরীরে কোথাও কেটে গেলে গাঁদা ফুলের পাতার রস অব্যর্থ। পাতা ঘষে বা বেটে সে কাটা জায়গায় প্রলেপ দিলে তৎক্ষণাৎ রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়, ব্যথা কমে যায় ও তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে। পাতার রস দিয়ে ঘা দুয়ে দিলে দ্রুত তা সেরে যায়। গাদা ফুলের পাঁপড়ি সামান্য মাখনের সাথে মিশিয়ে অল্প পরিমাণে কয়েকদিন খেলে অর্শের রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

অপরাজিতা: প্রস্রাব কম হলে বা কষ্ট পেলে অপরাজিতা গাছের শিকড়ের ছাল পানিতে সিদ্ধ করে দু’চার দিন খেলেই এ অসুবিধা চলে যাবে। সহজ প্রসবের জন্য সাদা অপরাজিতার শিকড় বাঁটা ১ গ্রাম পরিমাণ খাওয়ালে উপকার পাওয়া যেতে পারে। আর নীল অপরাজিতার শিকড় এক চামচ ঘি, মধু বা চিনির সঙ্গে খেলে অবশ্যই শুক্র রোগ সেরে যাবে ও শুক্র বৃদ্ধি হবে। ঠান্ডা লেগে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকলে বা চোখ জালা যন্ত্রণা হলে নীল অপরাজিতার পাতা পানি দিয়ে বেঁটে কপালে প্রলেপ দিলে যন্ত্রণা কমে যায়। কোষ্ঠকাঠিণ্য দুর করতে সাদা বা নীল অপরাজিতার বীজ গুড়ো করে ২ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে তাতে সামান্য চুন মিশিয়ে গরম দুধ বা পানি দিয়ে রাতে শোয়ার আগে খেতে হবে। নীল অপরাজিতার শিকড় বাঁটা খেলে বাত রোগের উপকার পাওয়া যায়।

নয়ন তারা: ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসায় নয়ন তারা অনন্য। এ রোগে আক্রান্ত হলে নয়নতারা গাছের কচি ডালের টাটকা রস ১০ মিলিলিটার বা ২ চা চামচ পরিমাণ কয়েকদিন রোজ সকাল বিকেলে খেলে এ রোগের উপশম হয়। ইতোমধ্যেই ভেষজ বিজ্ঞানীরা এ গাছের ডাল ও পাতা থেকে কান্সার নিরাময়ের প্রায় ৭০ টি ওষধ আবিস্কার করেছেন। শরীরের কোথাও কেটে গেলে বা ঘা বিষাক্ত হয়ে পেকে গেলে গাছের রস সাত দিন ব্যবহার করলে কাটা জোড়া লেগে যায়। এবং ঘা সেরে যায়। ব্লাড প্রেসার বা রক্ত চাপ বেড়ে গেলে নয়নতারা গাছের শিকড়ের রস এক চা চামচ পরিমাণ সকালে খালি পেটে একবার করে ৩-৪ দিন খেলে কিছুটা উপকার হতে পারে। বহুমূত্র বা ডায়াবিটিস রোগ সারাতে প্রতিদিন সকালে সাদা নয়নতারা ফুল গাছের দু’টি পাতা খালি পেটে চিবিয়ে খেলে এ রোগ মোটেই বাড়তে পারে না। পাতা বেটে রস খেলেও একই উপকার। এতে বহুমূত্র রোগ সারে না, তবে নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাসায় কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা যেমন বিষ পিঁপড়া, মাঝালি পিঁপড়া, বোলতা, মৌমাছি ইত্যাদি পোকা কামড়ালে বেশ যন্ত্রণা হয়, কামড়ানো জায়গা ফুলে যায়। সে জায়গায় নয়নতারা পাতা হাতে ডলে রস লাগালে তাৎক্ষণিক ভাবে উপশম পাওয়া যায়।

বকফুল: বকফুলের গাছ এক ধরনের আয়ুর্বেদিক তেল তৈরি করা হচ্ছে। এ তেল ব্যবহারে গণোরিয়া রোগে সুফল পাওয়া যায়। বুকে সর্দি বসলে এক চা চমচ পরিমাণ বকফুলের রস দিনে ৩ বার খেলে বসে যাওয়া সর্দি নরম হয়ে বেরিয়ে আসে। নাকে এলার্জি অর্থাৎ বার বার হাঁচি আসে, নিচু হলেই নাক দিয়ে পানির মত সর্দি গড়িয়ে পড়ে। এরূপ হলে পাতার টাটকা রস ২ চা চামচ পরিমান হালকা গরম করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া নাকের ছিদ্রে তিন ফোঁটা কারে পাতার ঠান্ডা রস দিলে পানির মত সর্দি পড়া বন্ধ হবে। বক ফুলে আছে প্রচুর ভিটামিন এ বা ক্যারোটিন। তাই রাতকানা রোগ হলে ফুল ভাজা নিয়মিত খেলে বা টাটকা পাতার রস ঘি দিয়ে গরম করে রোজ সকালে ১ চা চামচ খেলে উপকার পাওয়া যায়। গরম করা বা ফুটানো রস বেশি করে তৈরি করে ছেঁকে কাঁচের শিশিতে রেখে বহুদিন তা ব্যবহার করা যায়।

জবা: যে কোন সর্দি কাশি হলে জবা গাছের ৩-৪ গ্রাম টাটকা শিকড় পরিষ্কার করে পানি দিয়ে বেঁটে তার আধা কাপ ঠান্ডা পানিতে মিশিয়ে পর পর তিন দিন রোজ সকাল বিকালে খেলে তা সেরে যায়। টাক পোকায় অনেক সময় চুল গোড়া থেকে কেটে যে। সেখানে নতুন চুল গজালেও তা খেতে থাকে এ অবতস্থায় গোসল করার পর চুল শুকিয়ে জবাফুল বেটে লাগালে চুল গজায়। জবা ফুল বেঁটে চোখের উপর এবং নীচের পাতায় প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়।

সন্ধ্যামণি: পেট পরিষ্কার করতে সন্ধ্যামণি ফুলের পাকা কালো শুকনো বীজ ৩-৪ গ্রাম ভালভাবে গুঁড়ো করে রাতে খাবার পর শোয়ার সময় এক গ্লাস ঠান্ডা পানির সাথে খেলে সকালে কয়েক বার পায়খানার সাথে পেটে জমে থাকা মল বেরিয়ে পেট পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্শ রোগ কমোতে শিকড় সিদ্দ করে খেতে পারেন।

করবী: করবী গাছের কচি পাতার টাটকা রস চোখে দিলে চোখ ওঠায় আরাম পাওয়া যায়। দিনে দু’বার দিতে হবে। আঘাত লেগে ফুলে গেলে ৫০ গ্রাম কচি পাতা কুচি কুচি করে কেটে মাটির পাত্রে ১০০ মিলিলিটার পানি দিয়ে সিদ্ধ করে পানি কাইয়ের মত হলে তা সহ্যমত গরম অবস্থায় কয়েকদিন ফোলা জায়গায় লাগালে ফোলা কমে যায়। বিছে, মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুলে কামড়ালে কচি পাতা সিদ্ধ করে তার পানি দিয়ে কামড়ানো জায়গা ধুয়ে দিলে সেখানকার বিষ নষ্ট হয়, ফোলা যন্ত্রনাও কমে যায়। খোস পাঁচড়া সারাতে ব্যবহার করা হয় গাছের ছাল বাটা রস। করবীর শিকড় দুধ দিয়ে বেঁটে গোসলের তিন ঘন্টা আগে মাথায় মাখলে অকালে চুল পাকা বন্ধ হয়ে যায়।

লজ্জবতী: দীর্ঘদিন ধরে ঘা কমছে না। সে ক্ষেত্রে ৫ গ্রাম টাটকা পাতা সামান্য পানি দিয়ে বেটে ৩০ মিলি পরিমাণ জ্বাল দেয়া গরুর দুধে মিশিয়ে দিনে একবার খেতে হবে। এছাড়া তাজা পাতা বেঁটে ঘায়ে লাগিয়ে শুকনো পাতলা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলে তা সেরে যায়। এ সময় লবণ না খাওয়াই ভাল। দাঁতের মাড়ির ক্ষতে পাতাসহ ডাঁট ১০-১২ গ্রাম বেঁটে ক্বাথ তৈরি করে ১০-১৫ মিনিট মুখে নিয়ে বসে থাকলে ধীরে ধীরে তা সেরে যায়। দিনে ২-৩ বার এভাবে মুখে রেখে কুলি করলে উপকার পাওয়া যায়। সাদা আমাশয় সারাতে লজ্জাবতীর পাতাসহ ডাটা ১০ গ্রাম ১ গ্লাস পানিতে সিদ্ধ করে ২-৩ দিন রোজ সকাল সন্ধ্যায় ছেঁকে সে পানি পান করলে উপশম পাওয়া যায়। হাত পায়ের জ্বালা যন্ত্রণা কমাতে শিকড়সহ গাছ ১০ গ্রাম পরিমাণ ৪ কাপ পানিতে জ্বাল দিতে দিতে যখন পানি ১ কাপের মত হবে তখন তা নামিয়ে ঠান্ডা করে ছেঁকে খেতে হবে।

শিউলী: জ্বর সে নতুনই হোক বা পুরানোই হোক, ২চা চামচ পরিমাণ শিউলী পাতার রস একটু গরম করে সকাল বিকাল খেলে জ্বর ভাল হয়ে যাবে। এ ছাড়া এ রোগে ৬/৭ টি কচি পাতা সামান্য আদা দিয়ে বেঁটে সে রস ছেঁকে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এতে শরীরে জ্বালা বা দাহ কমাতে ভাল ফল দেয়। ক্রিমি কমাতে ২চামচ পরিমাণ পাতার রস রোজ সকাল বিকাল কয়েকদিন খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। শিশুরা তিতা রস খেতে চায়না । তাই শিশুদের জন্য তিতা রসের সাথে একটু চিনি মিশিয়ে ১ চা চামচ খাওয়াতে হবে। অরুচি হলে শিউলী পাতা ঘিয়ে ভেজে খেলে বা কচি পাতা মুগডাল বেঁটে বড়া বানিয়ে খেলে মুখে রুচি আসে। কফ বের করতে পাতার রস ২চা চামচ একটু গরম করে খেতে হবে। এতে বাত রোগের ও কিছুটা উপশম হয়। শিউলী বীজের গুড়ো সামান্য পানিতে গুলে মাথায় সব জায়গায় ভালভাবে ঘষে কয়েকদিন মাখলে খুসকি চলে যায়।

তরুলতা বা কুঞ্জলতা: যাদের রাতে ভাল ঘুম হয়না তারা তরুলতা গাছের শুকনো ডাল ও পাতার গুঁড়ো ৩ চা চামচ পরিমাণ,ঘি ১ চা চামচ এবং সমপরিমাণ মধু বা চিনি মিশিয়ে তাতে শোয়ার আগে খেয়ে দেখতে পারেন, সুনিদ্রা হবে। কোথাও কেটে গিয়ে বা আঘাত লেগে শরীরে যদি বিষাক্ত ঘা হয়ে যায় তবে কচি ডাল পাতা বেঁটে তার রস দিয়ে ঘা ভালভাবে ধুয়ে দিলে উপকার পাওয়া যায়। শুকনো গাছের গুড়ো ঘায়ের উপর ছড়িয়ে দিয়েও উপকার পাওয়া যায়। পিটে ফোঁড়া হলে পাত বেটে প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পেকে ফেটে যায়। অর্শ রোগ কমাতে গাছের পাতা বেঁটে ২ মিলি বা ৪ চা চামচ রস ২ চা চামচ ঘি দিয়ে খেলে উপকার হবে। উচ্চ রক্ত চাপের রোগীরা অর্শ সারাতে ঘি ছাড়াই খাবেন।

টগর: ক্রিমি কামতে ৫ গ্রাম পরিমাণ তাজা শিকড় সামান্য পানি দিয়ে বেঁটে সকালে খেলে ক্রিমি মরে যায়। অনেক সময় খাওয়ার পরদিন মলের সাথে মৃত ক্রিমি বেরিয়ে আসে। যে কোন কারণে দাঁতে যন্ত্রণা হলে শিকড় পরিস্কার করে অল্প করে চিবালে যন্ত্রণা কমে যায়। এ সময় লালা বা থুতু ফেলে দিতে হবে। গাছের সাদা কষ দিনে দু তিন ফোঁটা চোখে দিলে তিন দিনেই চোখ ওঠা ভাল হয়ে যায়। চোখ লাল হলে তাও কেটে যায়। বিষাক্ত ক্ষতে টগর গাছের কষ ও রস বিশেষ উপকারি। দুধের মত আঠা বা কষ দিনে একবার ক্ষত স্থানের উপর লেপে দিলে জ্বালা যন্ত্রণা কমে ও তাড়াতাড়ি সেরে যায়।

আসুন ছোট্র একটা ফুলের বাগান গড়ে তুলি: যেসব ফুল আমাদের এত উপকার করে হাতের কাছে তাদের গাছগুলো নিয়ে গড়ে তুলুন ছোট্র সুন্দর একটি ফুলের বাগান। বাড়ির সামনেই লাগান নানা রকম ফুলের গাছ। আর যেখানে ছাদ বারান্দাই শেষ ভরসা সেখানে টবে লাগান এসব ফুলের গাছ। পরিবেশ ও মনকে ভাল রাখি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪ফেব্রু২০২০