গবাদিপশুর রক্ত-প্রস্রাব এর কারণ ও প্রতিকারে করণীয়

690

FB_IMG_1550110393312-660x330
গবাদিপশুর আঁটুলিবাহিত একটি প্রটোজোয়াজনিত রোগ হলো ব্যাবেসিওসিস বা রক্ত-প্রস্রাব। এ রোগে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি গরুর মুত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী জীবজন্তুর আঁটুলিবাহিত রোগের মধ্যে এটি অন্যতম। আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা সহজ না হওয়ায় এ রোগে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। সাধারণত গরু ও মহিষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।

রোগের লক্ষণ
আক্রান্ত প্রাণীর বয়স ও রোগজীবাণুর প্রকারভেদে এ রোগের লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত ৯ মাস বয়স পর্যনত গরু মহিষ এ রোগে আক্রানত হয় না। এ রোগের লক্ষণগুলো হল ক্ষুধামান্দ্য ও উচ্চ তাপমাত্রা (১০৩-১০৭ ফা), পাল থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা, ঝিমানো ভাব, হাঁটাচলা করতে না চাওয়া , শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী (Mucous membrane) ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ,শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যাওয়া , রক্তশূন্যতা ও রক্তপ্রস্রাব দেখা দেয়।

কখনও কখনও রক্তপ্রস্রাব না হয়ে জন্ডিস দেখা দেয় , পাতলা পায়খানা বা কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হতে পারে , প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, গর্ভবতী গাভীর গর্ভপাত হওয়া , জন্ডিস ও জ্বরে আক্রান্ত বাচ্চার জন্ম হতে পারে। এ রোগে সংক্রমিত রত্তকণিকা (Erythrocytes) যদি মস্তিষ্কের রত্তজালিকায় (Capillaries) প্রবেশ করে তবে স্নায়ুজনিত সমস্যা যেমন চলাচলে অসঙ্গতি, দাঁত কড়মড় করা, তেড়ে আসা বা চলৎশক্তি হারিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

জরায়ুতে সংক্রমণ হলে দুর্বল, পাংশু (anemic), জন্ডিস এবং পানিশূন্যতায় ভোগে এরূপ বাছুর প্রসব করে এবং খিচুনি ও অন্যান্য স্নায়ুবিক সমস্যা ও পরিলক্ষিত হয়। সুস্থ হয়ে ওঠা পশু অত্যাধিক দুর্বল হয়ে থাকে এবং যথাসময়ে চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত প্রাণীর মৃত্যু (৪-৮ দিন) ঘটে। আক্রান্ত পশুতে উপরোক্ত সমসত লক্ষণ দেখা নাও দিতে পারে।

প্রতিরোধ:
রোগের বাহক আঠালীর নিয়ন্ত্রণ করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের দেশে যাঁরা সংকর জাতের গবাদিপশু পালন করেন, তাঁরা বিশেষত বর্ষার শুরু ও শেষে আঁটুলিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করে ব্যাবেসিয়াসহ অন্যান্য আঁটুলিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গবাদিপশুর স্থান পরিবর্তনে এ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নতুন কোনো গবাদিপশু পালে সংযোজনের পূর্বে অন্তত দুই সপ্তাহ পৃথক রেখে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

এ সময়ের মধ্যে যদি নবাগত পশু কোনো ধরনের রোগে আক্রানত না হয় তাহলে তাকে পালের অন্য গরুর সাথে রাখা যাবে। আর যদি কোনো প্রকার অসুস্থতা লক্ষ্য করা যায় তাহলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তার পর অন্য প্রাণীর সঙ্গে রাখা যেতে পারে। উর্লেখ্য যুত্তরাস্ট্রে প্রতিটি গবাদিপশুকে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ অন্তর আঠুলীনাশক প্রয়োগ করার কারণে ১৯৪৩ সালের পর থেকে এ রোগ পরিলক্ষিত হয়নি।

টিকা প্রয়োগেও এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। তবে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এ রোগের টিকা ব্যবহার শুরু হয়নি এবং দেশে পাওয়াও যায় না। এছাড়া রোগের প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপায়োনেট প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২.৫ মিলি করে ইনজেকশন দিলে গবাদিপশুকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যাবিসিওসিস থেকে মুত্ত রাখা যায়।

চিকিৎসা:
অসুস্থ গবাদিপশুকে প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রক্তশূন্যতা বা স্নায়ুবিক উপসর্গ (দাঁড়াতে না পারা, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি) দেখা দিলে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে রক্তশূন্যতার চিকিৎসা করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও তা করা সম্ভব হয়নি।

অ্যারোমেটিক ডায়ামিডিনস গ্রুপের ঔষধ যেমন ডিমিনাজিন ডাইএসিটুরেট (যেমন Berenil, Babcop vet) প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৮ গ্র্মম পরিশ্রত পানিতে (৬%) মিশিয়ে মাংসপেশীর বিরুদ্বে ইনজেকশন এ রোগের বিরুদ্বে কার্যকর। এছাড়া ইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপিয়োনেট (যেমন Babcure, Imicarp) প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.২ মিলিগ্রাম হিসাবে ত্বকের নিচে একবার ইনজেকশন বেশ র্কাযকর।

ইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপিয়োনেট রত্তের লোহিত কণিকার পৃষ্টদেশে সংযুত্ত হয়ে থাকে। ফলে ব্যাবিসিয়া জীবাণু লোহিত কণিকায় সংযুত্ত হতে পারে না। এছাড়া ইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপিয়োনেট লোহিত রত্ত কণিকায় ইনোসিটল প্রবেশে বাধা দেয়। ইনোসিটল ব্যাবিসিয়া জীবাণুর জন্য একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।

ফলে জীবাণুটি পুষ্টির অভাবে মারা যায়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে এর প্বার্শপ্রতিক্রিয়ার প্রতি কারণ ইমিডোর্কাব ডাইপ্রোপিয়োনেট এর এন্টি কোলিনস্টারেজ ক্রিয়া থাকায় তীব্র প্রকৃতির বিষক্রিযার মত লক্ষণ যেমন দূর্বলতা, অশ্রুপাত, লালাক্ষরণ, ঘাড় বেকে যাওয়া, কাপুঁনি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেেএ এট্রপিন সালফেট (ট্রপিন ভেট) ব্যবহার করতে হবে।

সহায়ক চিকিৎসা হিসাবে রত্ত সষ্ণালন অথবা রত্তের লোহিত কণিকা সষ্ণালন করা যেতে পারে। হিমাটিনিক মিক্সার যেমন কপার সালফেট ২ গ্রাম, ফেরাস সালফেট ২ গ্রাম ও কোবাল্ট ক্লোরাইড ১০ মিগ্রা, ২৫০ মিলি পানির সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন ১ বার করে ১০ দিন খাওয়ানো ভাল।

সুনির্দিষ্ট ঔষধ পাওয়া না গেলে ৮-১৬ গ্রাম অ্যালাম বা ফিটকিরি ও একই পরিমাণ বোরিক এসিড ২৫০ মিলিলিটার পানির সাথে মিশিয়ে দিনে তিন বার করে ৩ দিন খাওয়াতে হবে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭জানু২০২০