কমছে না কৃষির খরচ

1101

KRISHE-12
কৃষির উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, তবে তা শুধু চাষ ও সেচের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মাড়াই, রোপণ, ফসল কাটা, সার প্রয়োগ, শুকনো ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখনো খুবই কম। সারা দেশে ফসল লাগানোর জন্য মাত্র ১ শতাংশ বা তারও কম জমিতে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। আর ফসল কাটা থেকে শুরু করে শস্য বাছাই পর্যন্ত অন্যান্য ধাপে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। এ পরিস্থিতি ফসল উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি ও অবচয়ের প্রধান কারণ।

সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ হয় ১৮ থেকে ১৯ টাকা। কিন্তু উৎপাদনের সব ধাপ (জমি চাষ, সেচ, রোপণ, ফসল কাটা ও মাড়াই) আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে করা গেলে এ খরচ দাঁড়াত ৯ থেকে ১০ টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় অর্ধেকে নামত। এতে লাভবান হতেন কৃষক। শুধু ব্যয়ই নয়, যন্ত্রের ব্যবহারে কমে যেত অপচয়। অন্যদিকে খাদ্যের গুণগত মান ঠিক থাকত।

দেশে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও কেনার জন্য কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কোনো ঋণ পান না। অর্থায়নের অপর্যাপ্ততা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বড় প্রতিবন্ধকতা। ঋণ সহায়তা আরো সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করা গেলে কৃষিযন্ত্রের আরো প্রসার ঘটবে। কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সরকার ভর্তুকি দেবে বলে জানিয়ে আসছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক।

কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফসল লাগানোর আগে জমি তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের ব্যবহার হচ্ছে ৯০-৯৫ ভাগ জমিতে। ৭৬ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় পাম্পের মাধ্যমে। উন্নতি হয়েছে কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রেও।

এদিকে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, আমদানিনির্ভর এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক কৃষক সেগুলোর ব্যবহার বাড়াতে পারছেন না। তথ্যানুসারে, দেশে এখনো পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের শতকরা ৯৫ ভাগ, চারা রোপণ যন্ত্রের শতভাগ, বীজবপন যন্ত্র ৭০ ভাগ ও ফসল কাটার যন্ত্রের (রিপার) ৯৯ ভাগ আমদানিনির্ভর। এছাড়াও সেচ মেশিন, স্প্রে মেশিনের একটি অংশ আমদানি করা হয়, কিছুটা দেশেও তৈরি হচ্ছে।

কৃষিযন্ত্রের বাজার নিয়ে তথ্য রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের কাছে। ওই বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল আলম বলেন, কৃষি যন্ত্রপাতির ১০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫ ভাগই বিদেশের দখলে। বিশেষ করে দামি ও বড় যন্ত্রগুলোর বাজার ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও জাপানের দখলে।

তিনি বলেন, চাহিদার বাকি ৩৫ শতাংশ তৈরি হচ্ছে দেশে। তবে এর মধ্যে ছোট উপকরণ বেশি। স্থানীয়ভাবে এসব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ তৈরিতে বর্তমানে দেড় হাজার ছোটবড় কারখানা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ছোট ছোট বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করছে। দেশে বড় যন্ত্রগুলোর উৎপাদন বাড়লে কম মূল্যে ও সহজে সেগুলো কৃষকদের কাছে পৌঁছানো যেত।

এদিকে জানতে চাইলে দেশে কৃষিযন্ত্রের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলীমুল এহছান চৌধুরী বলেন, সময়ের সঙ্গে কৃষিযন্ত্রের ধরন পাল্টাচ্ছে। বাজার বড় হচ্ছে। সে অনুযায়ী পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের উৎপাদকরা এগিয়ে যেতে পারছে না। ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির গতি বেশ মন্থর।

কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গবেষক এবং যন্ত্রপাতি উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, এক দশক ধরে জিডিপিতে কৃষিখাতের অংশ কমে শিল্প ও সেবাখাতের অংশ বেড়েছে। মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ফলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের কৃষিখাতে শ্রমিকসংকট বাড়ছে। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, মোট শ্রমিকের প্রায় ৪১ শতাংশ এখন কৃষিতে নিয়োজিত, যা ২০০২-৩ অর্থবছরে ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। যদিও বাড়তি জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭জানু২০২০