আমরা গতানুগতিক খাদ্যের ছক থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে মাছ, মাংস ও ডিমের প্রতি ঝুঁকছে মানুষ। মানুষের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে তুলনামূলকভাবে মাছ খাওয়ার হার বেড়েছে। কমেছে দুধ ও চিনি খাওয়ার প্রবণতা।
এদিকে গরু ও খাসির চেয়ে মুরগির মাংস খাওয়ার হার বেড়েছে। এ ছাড়া ভাতের বাইরে অন্য খাবার গ্রহণের হারও কিছুটা বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে। এ জন্য নন-ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ কম করছে। কারণ এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এ ছাড়া খাদ্যাভাস পরিবর্তনে আর্থিক স্বচ্ছলতারও একটা সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। এ জন্য পুষ্টি চাহিদা পূরণে শুধু ভাতের ওপর নির্ভরশীল থাকছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান খানার আয়-ব্যয় নির্ধারণ জরিপের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, মানুষ ভাত ও আটা খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তবে বেড়েছে ডিম ও মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ। ২০০৫ সালে একজন মানুষ গড়ে ৬ দশমিক ৮৫ গ্রাম মুরগি মাংস খেতো। ২০১৬ সালে তার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৩৩ গ্রামে। তার মানে এক দশকের ব্যবধানে মুরগির মাংস খাওয়ার হার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
একই অবস্থা ডিমেও। ২০০৫ সালের জরিপ অনুসারে, একজন মানুষ বছরে গড়ে ডিম খেতো ৫ দশমিক ১৫ গ্রাম। ২০১৬ সাল শেষে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৫৮ গ্রামে। তার মাসে একজন মানুষ এক দশকের ব্যবধানে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছেন দেড়গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, পোল্ট্রির মাংস ও ডিম এখন তুলনামূলক সহজলভ্য বলা যায়। এ জন্য পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম খাওয়ার প্রচলন বাড়িয়ে মানুষকে অনেক রোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব।
জনাব তিনি বলেন, ডিমের যে যে উপকারিতা আছে তার প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। কেননা মানুষের শরীরের যে স্বাভাবিক ডিমের চাহিদা তা পূরণ হলে রোগ কম হতো। ওষুধের পরিমাণ কম লাগতো। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকত। সে জন্য এ সেক্টর নিজেদের প্রস্তুত করেছে। ব্যাপক হারে উৎপাদনও বাড়িয়েছে।
বিবিএসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাছ গ্রহণের হার ২০১০ সালে ছিল দৈনিক গড়ে ৪৯.৫০ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা ৬২.৫৮ গ্রাম হয়েছে। দুধ ও দুধজাত খাবার গ্রহণের হার ৩৩.৭২ গ্রাম থেকে কমে ২৭.৩১ গ্রাম হয়েছে। ফল গ্রহণ ৪৪.৭০ গ্রাম থেকে কমে ৩৫.৭৫ গ্রাম, চিনি ৮.৪০ গ্রাম থেকে কমে ৬.৯০ গ্রাম হয়েছে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব উপাদানের বাইরে অন্য খাবার আগে গড়ে ৭২.৭৮ গ্রাম খাওয়া হলেও এটি বেড়ে এখন ৮০.৬২ গ্রাম হয়েছে।
স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য সবকিছুই খেতে হবে। মানবদেহের জন্য একটা ব্যালেন্সড নিউট্রেশন দরকার। আমাদের দেশে মানুষ ততটা স্বাস্থ্য সচেতন না। কিন্তু আশার কথা হলো এ সচেতনতা দিনদিন বাড়ছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন।
তিনি বলেন, ‘‘একজন মানুষের গডে ১০৫-১১০টা ডিম খাওয়া উচিত। উন্নত দেশে এর চেয়ে বেশি ডিম খায় মানুষ। অনেকে সকাল শুরু করেন ডিম দিয়ে নাস্তা করে। এভাবে তারা বছরে প্রচুর ডিম খায়। এতে তাদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।’’
পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ।
সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশে জনপ্রতি মুরগির মাংস খাওয়ার পরিমাণ বছরে প্রায় ৬.৩ কেজি। উন্নত বিশ্বের মানুষ খায় বছরে গড়ে প্রায় ৪০-৪৫ কেজি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) মতে, জনপ্রতি ন্যূনতম ডিম খাওয়া উচিত বছরে ১০৪টি। উন্নত বিশ্বে বছরে জনপ্রতি গড়ে প্রায় ২২০ টির মতো ডিম খাওয়া হয়। জাপানে জনপ্রতি ডিম খাওয়ার সংখ্যা বছরে প্রায় ৬০০টি। আমাদের দেশে এ সংখ্যা জনপ্রতি মাত্র ৯০টি।
দেশে অন্য সব পণ্যের পাশাপাশি পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে বাজারে যেসব মাংস পাওয়া যায়, তার সবই প্রায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কিন্তু পোল্ট্রি খাতের বিকাশের কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের দাম মানুষের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। ফলে পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণে এ দুটি পণ্যের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘টেকশই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে চাইলে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডিম ও পোল্ট্রির মাংস স্বাস্থ্য ও মেধা সম্পন্ন জাতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি জানান, ডিম ও মুরগির মাংস খাওয়ার ব্যাপারে সচেতনতার সৃষ্টির ওপর জোর দিতে হবে। কেননা এর সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক একটা গুরুত্ব আছে। গত কয়েক বছরে এ খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। এ বিনিয়োগ আরও বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব। ফলে বাড়বে কর্মসংস্থান। যা স্বনির্ভর জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেন, ‘‘মানুষের খাদ্যাভাস পরিবর্তন হচ্ছে, এটা ভালো সংবাদ। নতুন জরিপ অনুসারে, মানুষ ভাত ও আটা খাওয়ার প্রতি ঝোঁক কমেছে। অন্যদিকে সবজি, মাছ মাংস ও ডিম খাওয়ার হার বাড়িয়েছে। এটা মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রমাণ। কেননা ভাতে কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে। এ জন্য ডিম, মাংস, মাছ ও সবজির ভাগ বাড়লে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।”
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন