বন্য প্রাণিদের বাচ্চা হয় প্রকৃতির যত্নে কিন্তু আমাদের অধীনস্ত গৃহপালিত প্রাণিদের বংশ বৃদ্ধিতে আমাদের রাখতে হয় সতর্ক দৃষ্টি। কারণ তাদের ভাল বাচ্চা ধারণ ও প্রসবের জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত যত্নের ।
একটি সুস্থ গাভী জন্ম দিতে পারে একটি সুস্থ শাবক। শুধু তাই নয় সাথে সাথে দিতে পারে চাহিদামতো দুধ। আমাদের একটু সচেতা এবং প্রাণিদের প্রতি সহানুভব দৃষ্টিভঙ্গি তথা গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন গাভীর বিশেষ যত্নে পর্যাপ্ত দুধ ও সুস্থ সবল বাছুর পেতে সহায়ক । যা শুধু তাদের জন্যই ভাল নয় বরং তা মালিকের অর্থনীতিক চাহিদা পুরণেরও একটা বিশেষ সুযোগ হয়ে দাড়ায়।
গাভীর গর্ভকালঃ
গাভী সাধারণত (২৮২ +/- ৫) দিন বা প্রায় সাড়ে ৯ মাস। গর্ভাবস্থায় বয়স অনুযায়ী খাদ্য ও যত্ন প্রয়োজন। তাই প্রতিটি গাভীর প্রজননের সঠিক সময় জানা অত্যান্ত জরুরী।
গর্ভকাল নির্ণয়ের জন্য করণীয়ঃ
১ বীজ দেয়ার (ষাড় দেখানোর) আড়াই থেকে তিন মাস পর প্রাণি চিকিতসক দ্বারা পরীক্ষা করে গর্ভ ধারণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা থেকে বাচ্চা প্রসবের সম্ভব্য দিন নির্ণয় করা হয়।
গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে বাচ্চা প্রসবের দুই মাস পুর্ব পর্যন্তঃ
২ এই সময় যথেষ্ঠ পরিমাণ সুষম ও সহজ পাচ্য খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । সেই সাথে পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিন ও মিনারেল থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে করে রুচি সহকারে তৃপ্তির সঙ্গে খাদ্য খেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।,
৩ গাভীকে যথাসম্ভব আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪ গাভী যাতে কোন রকম দৌড়ঝাপ বা অন্য প্রাণির সাথে লড়াই না করে সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৫ তাজা ঘাস সরবরাহ করতে হবে। দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি আশ জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।
৬ গর্ভবতির গাভীর দ্বারা হালটানা , শষ্য মাড়াই এর কাজ করানো যাবে না।
গর্ভবস্থার শেষ দুই মাসের পরিচর্যাঃ
দুধ উৎপাদনে শেষভাগে গাভীর দেহে সঞ্চিত ভিটামিন,খনিজপদার্থ ও চর্বি ও অনান্য পুষতিকর উপাদান সমুহ প্রায় নিশ্বেষ হয়ে যায়। তাই এই দুই মাসে অতিরিক্ত পরিচর্যার প্রয়োজন। এই সময়ে
১. গাভীকে পুর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
২. সাস্থের উপর বিবেচনা করে দানাদার খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে সহজ পাচ্য খাদ্যের পরিমান বাড়াতে হবে। সাথে কাচা ঘাস খাওয়ালে ভাল হয়।
৩. এই সময় গাভীকে অবশ্যই পাল থেকে সরিয়ে আলাদা যায়গায় রাখতে হবে।
৪. গাভীকে সপ্তাহে দুইদিন গোসল করানো উত্তম।
৫. ২-৩ পুর্বে গাভীকে বাচ্চা ঘরে প্রসব ঘরে বা বিষেষ করে খড় বিছানো মেছেতে নিতে হবে। প্রসব ঘরো পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই জীবানুমুক্ত রাখতে হবে।
প্রসব পূর্ববর্তী লক্ষণঃ
১. প্রসবের সময় যত এগিয়ে আসবে সেই সঙ্গে উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যাবে। যা
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে বাচ্চা দ্রুত বড় হওয়ার ফলে গাভীর পেটের ডান দিক খুব স্ফিত হয়।
২. ওলান বেশ বড় ও বাটগুলো সচেজ ও টানটান হয়।
৩. যোনিমুখ স্ফীত ও শিথিল ও থলথলে হবে।
৪. যোনিমুখ দিয়ে পরিষ্কার পদার্থ নির্গত হবে।
৫. গাভীর রুচি হ্রাস পায় এবং খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়। নিচু স্বরে শব্দ করে।
৬. বাচ্চা প্রসবের পুর্ব মুহূর্তে প্রচন্ড ভীত ও উৎকণ্ঠিত দেখায়।
৭. সাধারণত গাভী মেঝেতে শুয়ে পড়ে এবং বাচ্চা প্রসব আরম্ভ হয়।
প্রসূতির ঘরঃ
আসন্ন প্রসবা গাভী অনান্য প্রাণির সাথে রাখলে নানা রূপ সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আলাদা ভাবে রাখার জন্য প্রসূতি ঘরের প্রয়োজন।খামারে প্রজনক্ষম গাভীর মোট সংখ্যার পাঁচ ভাগ প্রসূতি ঘর রাখা হয়। প্রসূতি ঘরের ৩৪ মিটার অংশ আবৃত এবং ৩৪ অংশ দেয়াল দিয়ে খোলা জায়গা থাকে। আবৃত ঘরের ১ মিটার উচু দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং খোলা অংশ দিয়ে ১২ মিটার চওড়া দরজা রাখা হয়। প্রসূতি ঘরের মেঝ পাকা হওয়া প্রয়োজন ।ঘরের মেঝেতে খড় বিচালী দিতে হয়। প্রসুতি ঘরে একটি করে পানি ও খাবার পাত্র থাকে।
বাচ্চা প্রসব প্রস্তুতিঃ
১. বাচ্চা প্রসব হওয়ার লক্ষণ প্রসব পাওয়ার পর বাচ্চা প্রসবের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
২. প্রতিকুল অবহাওয়ায় গাভীর আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রসব ঘরে গাভীকে রাখার পুর্বে যত্ন সহকারে পরিস্কার পরিছন্ন জীবানু মুক্ত করতে হবে।
৪. স্বাভাবিক প্রসব হলে বাচ্চাকে মায়ের কাছে রাখতে হবে।
৫. এই সময় ধারলো জীবানুমুক্ত ছুরী দ্বারা দ্রুত নাভি কেটে দিতে হবে।
৬. গাভীর প্রসবের রাস্তা জীবানু নাশক ডেটল বা স্যাবলন মিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
৭. সহজে গর্ভফুল মাটিতে পড়ার জন্য কুসুম কুসুম গরম পানি সরবরাহ করতে হবে।
৮. পানিতে পড়ার সাথে সাথে গর্ভফুল মাটিতে পুতে দিতে হবে, কেননা গর্ভফুল কোঙ্ক্রমে গাভী খেয়ে ফেললে দুদ্ধ উতপাদনের ক্ষমতা মারাত্বক ভাবে কমে যায়।
৯. প্রসবের পর মায়ের প্রথম শালদুধ বাচ্চাকে খেতে দিতে হবে এবং বাচ্চাকে বাট চুষতে দিতে হবে।
১০. এই সময় গাভীকে সহজ পাচ্য খাবার সরবরাহ করতে হবে, কাচা ঘাস দেয়া যেতে পারে।
প্রসব কালীন সমস্যাঃ
স্বাভাবিক প্রসবে বাচ্চার সামনের দুটি পা এবং নাক মুখ একসাথে যোনি দারে প্রথমে বের হয় এবং ক্রমশ ধীরে ধীরে ঘাড় ,দেহের মধ্যাংশ ,কোমরের নিম্নগাভ এবং অবশেষ পিছনের পা বের হয়ে আসে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তা প্রসব কালীন সমস্যা ধরা হয়। তখন প্রসবে অভিজ্ঞ বা ভেটেরিনারিয়ানের সাহায্য নিতে হয়। প্রসব কালীন সময়ে সৃষ্ট জটিলতা অনভিজ্ঞ, ভেটেরিনারিয়ান নয় এমন ব্যক্তি দ্বারা করালে মারাত্বক ক্ষতি হওয়ার আশংখ্যা থাকে।
যখন ডাক্তারের সাহয্য নিবেনঃ
১. পানি থলী বের হওয়ার ২-৪ ঘন্ঠার মধ্যে বাচ্চা প্রসব না হলে।
২. ২-৪ ঘন্ঠার মধ্যে কোথ দেয়ার পর বাচ্চা প্রসব না হলে ।
৩. বাচ্চার সামনের পা ছাড়া অন্য কোন পা প্রথমে বের হলে।
সতর্কতাঃ
বাচ্চা গাভীর পায়ের দিকে বা নিচের দিকে টানতে হয়। কুসুম কুসুম গরম পানি মৃদু সাবান যোনি দারের চারদিকে লাগাতে হয় ।
অপ্রয়োজনীয় দৈহিক বল প্রয়োগ করে বাচ্চা টানা উচিত নয়। যত্নহীন বা অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অবলম্বন হতে বিরত থাকতে হবে।
দেশি গরু বা ছোট আকৃতির গাভীতে বড় আকৃতির ষাড়ের বীজ দেয়া হতে বিরত থাকতে হবে।
গাভীর গর্ভাবস্থায় উপরোক্ত পরিচর্যা গুলো মেনে চললে আমরা পেতে পারি একটা সুন্দর বাছুর আর সুস্থ গাভী। সেই গাভী থেকে পেতে পারি পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ। যা আমাদের নিজেরদের চাহিদা যেমন পুরণ হবে , সাথে সাথে দেশের জাতিয় চাহিদা পুরণে সামান্য হলেও অবদান রাখা যাবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৩মার্চ২০