বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান, কোথাও হচ্ছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কোথাও বা গলছে বরফ। বাংলাদেশে চলতি বছরে চৈত্র মাসের বৃষ্টিতে হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে, আর কার্তিক মাসেও হচ্ছে বর্ষাকালের মত টানা বর্ষণ। কিন্তু মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি জলবায়ু পরিবর্তন ধারণাটি হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিকে দুর্বল করার চীনা ষড়যন্ত্র। আর এইজন্য জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে ঐতিহাসিক প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করেছেন তিনি। এই বিষয়টি সামনে রেখেই নিউইয়র্ক টাইমস জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল বিষয়টি পাঠকদের জন্য সরলভাবে তুলে ধরেছে। ইত্তেফাকের পাঠকদের জন্য সেই বিষয়গুলো ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে তুলে ধরা হল”
আমরা জলবায়ু পরিবর্তন বলবো না ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’ (গ্লোবাল ওয়ার্মিং)?
দুইটাই সঠিক, কিন্তু তারা দুটি ভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে থাকে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে এক ধরণের জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থটা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির বাইরে ও অন্যান্য বিষয় যেমন বৃষ্টিপাতের ধরণের পরিবর্তন বুঝিয়ে থাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গত কয়েক বছর শীত বেশি পড়ায় বিজ্ঞানীরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে এখন জলবায়ু পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করেছে। কিন্তু তার এই দাবি মিথ্যা, বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা কতটা বাড়ছে?
১৮৮০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৩৭ বছরের হিসেবে সংখ্যাটা ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু পুরো গ্রহের গড় তাপমাত্রার হিসেবে অনেক বেশি। এই জন্যই মেরু অঞ্চলের বরফ গলা শুরু করেছে এবং সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পাবে যাতে পৃথিবীর বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গ্রিনহাউজ এফেক্ট কি এবং সেটা কিভাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে প্রভাবিত করছে?
গত এক শতাব্দী ধরেই আমরা গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত। ১৯ শতকের দিকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন বায়ুমণ্ডলে থাকা কিছু গ্যাস তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকে রাখছে যা সাধারণত মহাশুণ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস এর মধ্যে অন্যতম। বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইড না থাকলে পৃথিবী তুষারাবৃত বিরানভূমি হত। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানীরা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে মানুষ যত বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস ত্যাগ করবে পৃথিবীর তাপমাত্রা তত বৃদ্ধি পাবে। শিল্পযুগের তুলনায় বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে যে অনুমান করেছিলেন ঠিক ততটাই বেড়েছে।
কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য কি মানুষ দায়ী?
হ্যাঁ, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তথ্য উপাত্ত ও তেজস্ক্রিয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ও শিল্পযুগের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পার্থক্য নিরূপণের পরে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে বাড়তি গ্যাস মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও কমা প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে কিন্তু সে প্রক্রিয়াতে সময় লেগেছে হাজার হাজার বছর। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, মানুষ যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে।
কি কারণে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞান অস্বীকার করে?
বেশিরভাগ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞান অস্বীকার করে মতাদর্শগত কারণে। কিছু রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিমালা বাজার সহায়ক করে তোলার পরিবর্তে এর বিজ্ঞানটিকেই মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনো বলেছেন, বিজ্ঞানীরা বিশ্বের সবাইকে বোকা বানানোর জন্য ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ প্রচার করছে অথবা মার্কিন শিল্পকে ধ্বংস করতে এটা চীনের ছড়ানো ষড়যন্ত্র। জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী রাজনীতিবিদদের যুক্তি এত বেশি খাপছাড়া যে তেল ও কয়লা কোম্পানিগুলো এখন তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে যদিও কোনো কোন কোম্পানি এখনো এসব রাজনীতিবিদের প্রচারণায় অর্থায়ন করে থাকে।
আমরা কি পরিমাণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি?
পৃথিবী ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে জলবায়ু ক্রমাগত উষ্ণ হতে থাকবে। কোরাল রিফ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল জীবজগতে ইতিমধ্যে মড়ক লেগে গেছে। যদি দীর্ঘমেয়াদে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় বৈশ্বিক রাজনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে, শরণার্থীদের ঢেউ নামবে এবং পৃথিবীতে ষষ্ঠ বৃহত্তম প্রাণী ও বৃক্ষের বিলুপ্তির সূচনা শুরু হবে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বিশ্বের বেশিরভাগ উপকূলীয় শহর ডুবে যাবে। বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ হবে জলবায়ু শরণার্থী।
বর্তমান বিষম আবহাওয়ার জন্য কী জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী?
এর কিছু কিছু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা উপাত্ত প্রকাশ করেছেন যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে লু হাওয়া, প্রচণ্ড বজ্র ঝড়বৃষ্টি, উপকূলীয় বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্যালিফোর্নিয়ার খরা পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
এই সমস্যার কোনো বাস্তবিক সমাধান কী আছে?
হ্যাঁ সমাধান আছে, কিন্তু পরিবর্তনটা খুব ধীরে হচ্ছে। বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি একমাত্র তখনই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে যখন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। ভাল খবর হচ্ছে সীমিত জ্বালানি নির্ভর গাড়ি, পাওয়ার প্ল্যান্টের কঠোর ভবন ও কার্বন নিঃসরণ নীতিমালার কারণে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাবগুলো এড়াতে এই বিষয়গুলো আরো অনেক দ্রুত কার্যকরের আহ্বান জানাচ্ছেন।
জলবায়ু বান্ধব জ্বালানি নীতি কী অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর?
বায়ু, সোলার, পানিবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে পরিচালিত পাওয়ার প্ল্যান্টও অনেক কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। স্বল্পমেয়াদে ভাবলে এই উৎসগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক ব্যয়বহুল মনে হতে পারে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা ও বায়ুদূষণ কমানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমে সেই বিনিয়োগ সুদসমেত হাসিল হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার বড় হওয়ার জন্য এর খরচও কমে আসছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উদ্ভবে কয়লা কোম্পানির মত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এতেও নতুন চাকরি তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে কয়লা খনি শিল্পের দ্বিগুণ মানুষ কাজ করে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ব্যক্তি আমার কী করার আছে?
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন জলবায়ু পরিবর্তনকে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীকে মিলে মোকাবেলা করতে হবে। সবাইকে মিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে যত সম্ভব কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে নাগরিক হিসেবে আমরা পরিবর্তনের ডাক তুলতে পারি। ব্যক্তি পর্যায়ে যতটা সম্ভব কার্বন নিঃসরণ কমানো যায় সেই উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সূত্র: ইত্তেফাক
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম