জেনে নিন খামারে গো-খাদ্য বানানোর কৌশল

1307

download
আমরা জানি, কেজি প্রতি ২১.৭০ টাকা দামটা শুনে অনেক বড় খামারী বলবে অসম্ভব হতেই পারেনা।আমরা তাদের সাথে একমত। কারণ বড় খামারীদের এই খাবার বানানোর পিছনে অনেক খরচ থাকে। তাদের মেশিন চালাতে হয়, লেবার থাকে ১০-১২ জন, ইলেক্ট্রিসিটি বিল ইত্যাদি ইত্যাদি। বড় খামারীদের দানাদার খাবার না বানিয়েও খাওয়ানো সম্ভব না।

আমরা ছোটরা যেভাবে খাদ্য উপাদান মিক্স করে খাওয়াই এটা বড় খামারীদের সম্ভব না কারণ ওতে অনেক ঝামেলা, কিন্তু ছোট খামারীরা দানাদার খাবার না বানিয়ে শুধুমাত্র খাবার উপাদানগুলো একটা পাত্রে মিক্স করেই খাওয়াতে পারে।

আমরা সবাই জানি অফ সিজন জানুয়ারী-ফেবুয়ারী মাসে খাবারের মুল্য থাকে সব চেয়ে বেশী, এই বেশী মুল্যের বাজারেও গো-খাদ্যের কেজি প্রতি দানাদার খাবারের মুল্য দাঁড়াবে ২১.৭০ টাকা কিন্তু বাজারে প্যাকেটজাত দানাদার খাবারের দাম সর্বনিম্ন ২৫ টাকা আর সর্বোচ্চ দাম ৩১.৬০ টাকা । আপনি যদি ভালো মানের খাবার খাওয়াতে চান তাহলে ৩১.৬০ টাকার দানাদার খাবার কিনে খাওয়াতে হবে। আর যদি নিজে বানিয়ে খাওয়ান আমাদের কেজি প্রতি ৯ টাকা সাশ্রয় হয়। তাহলে কোনটা করা উচিৎ? হিসেব করেন এখন মাসে কত কেজি খাবার আপনার দরকার, আর ৯ টাকা সাশ্রয় হলে কত টাকা বাড়তি থাকছে আপনার হাতে? আপনার কর্মচারী চাইবে কেনা ফিড খাওয়াতে তাহলে ওদের কষ্ট কম হবে।

অন্যদিকে আমরা কি জানি বিভিন্ন কোম্পানীর প্যাকেট দানাদার খাদ্যে কি খাদ্য উপাদান, কি গুনগত মান আছে? অন্ধ হয়ে বোকার মত খাওয়াতে হবে। নিজেরা যদি এই খাবার বানিয়ে নেই—-কোম্পনী ওয়ালারা বলবে আমাদের খাবারে এই ভিটামিন নাই, সেটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় অমুক করা হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা এসব বিশ্বাস করতে নারাজ।আমরা যদি নিজে ভাল জায়গা থেকে খাদ্য উপাদান কিনে যাচাই করে নিজে বানিয়ে নেই এতে আর কিছু না হোক মানসিক একটা শান্তি পাওয়া যাবে। আর অন্যের বুদ্ধিতে ঠকার চাইতে, নিজের বুদ্ধিতে ঠকা অনেক ভাল। এটা আমার অভিমত। যাইহোক এই উধ্বগতির বাজার মুল্যেও কেজি প্রতি ২১.৭০ টাকায় কি ভাবে কোন উপাদান দিয়ে খাবার বানাবেন তার একটা উদাহারন দিলাম।

ধরা যাক আপনি ৬ কেজি দানাদার খাবার বানাবেনঃ (দুধের গরুর জন্য)
বর্তমান বাজারে কেজি প্রতি দামঃ গমের ভুষিঃ ২২ টাকা, কুড়াঃ ২০ টাকা, ভুট্টাঃ ২১ টাকা, খুদঃ ১ কেজি, তিলের খৈলঃ ২৬.৬৭ টাকা।
খাবার মিকচারঃ গমের ভুষি ৩ কেজি=৬৬ টাকা, কুড়া ১ কেজি= ২০ টাকা, ভুট্টা ১ কেজি ২১ টাকা, খুদ ১ কেজি= ২২ টাকা, তিলের খৈল ২৫০ গ্রামঃ ৬.৬৭ টাকা। মোট দাম ৬.২৫০ কেজি খাবারের জন্যঃ ১৩৫.৬৭ টাকা, তাহলে কেজি প্রতি দাম আসলো ১৩৫.৬৭/৬.২৫০= ২১.৭০ টাকা।

এখন আমার এই খাবারের গুনগত মান নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আসতে পারে, অনেকে বলবে ভিটামিন দেয়া হয়নি, খেসারী, মাসকলাই, ছোলা ভুষি দেয়া হয়নি, । ভিটামিন প্রত্যেকদিন খাওয়াতে হয়না। দুধের গরুকে ক্যলসিয়াম দেয়া যেতে পারে প্রতিদিন, যা প্যাকেট খাবার কিনলেও ভেটেরিয়ানরা বলবে খাওয়াতে। জিঙ্ক আর ভিটামিন সব সময় দেয়া লাগেনা। এই অফ সিজনে আমাদের নিজেদের তৈরি করা খাবারের দাম যদি পড়ে ২১.৭০ টাকা, আমি বলতে পারি সিজনের সময় এর দাম কেজি প্রতি আরো ২ টাকা কম হবেই।

গত সপ্তাহ থেকে মাথায় ঘুরছে আমার গরুগুলাকে ভুট্টা খাওয়াতে পারিনা কিন্তু সামনে আর ২ মাস পরেই ভুট্টার সিজন আসছেতে। তখন ভুট্টা ১৪-১৫ টাকার মধ্যে কিনে রাখা যাবে। তাই গত ১ সপ্তাহ ধরে গরুকে অল্প অল্প করে ভুট্টা খাওয়াতে শুরু করেছি। এভাবে ভুট্টা খাবার টা গরু ধরে ফেললে আমি ধীরে ধীরে বকন, ষাড় আর গাভীন গুলোকে গমের ভুষির পরিমান টা কমিয়ে দিবো আর ভুট্টার পরিমানটা বাড়িয়ে দিবো, কারন ভুষির দাম থাকে সব থেকে বেশী। কিন্তু দুধের গরুর জন্য ভুষি অনেক জরুরী, দুধের গরুকে কমানো যাবেনা। এভাবে যদি ভুষির পরিমান কমিয়ে ভুট্টার পরিমান বাড়িয়ে গরুকে খাওয়াতে পারি আমার ধারনা কেজি প্রতি আরো ২ টাকা সাশ্র্য় করা যাবে আজ থেকে ২ মাস পরে।

অনেক হয়তো প্রশ্ন করবেন ভুট্টার খাদ্য গুনাগুন আর ভুষির খাদ্য গুনাগুন কি এক? উত্তর হচ্ছে, ভুট্টার খাদ্য গুনাগুন গমের ভুষির থেকে বেশী, সমস্যা হচ্ছে ভুট্টা সব গরু হজম করতে পারেনা যতটা দ্রুত গমের ভুষি পারে। গমের ভুষি একেবারে বাদ দেবার কথা বলছি না, গমের ভুষির পরিমানটা কমিয়ে দেবার কথা বলছি।
ভুট্টার (Corn) খাদ্য গুনাগুনঃ প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরী ৩৬৫, ফ্যাটঃ ৪.৭ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ৩৫ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ২৮৭ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৭৪ গ্রাম, প্রোটিনঃ ৯ গ্রাম।
গমের ভুষির (Wheat Bran) খাদ্য গুনাগুনঃ প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরী ২১৬, ফ্যাটঃ ৪.৩ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ২ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ১১৮২ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৬৫ গ্রাম, প্রোটিনঃ ১৬ গ্রাম, ডায়েট্রি ফাইবারঃ ৪৩ গ্রাম, সুগারঃ .৪ গ্রাম
কুড়ার (Rice Bran) খাদ্য গুনাগুনঃ প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ ক্যালরী ২২৪, ফ্যাটঃ .৯ গ্রাম, সোডিয়ামঃ ৭ মিগ্রা, পটাশিয়ামঃ ৪৪ মিগ্রা, কারবোহাইড্রেটঃ ৮৬ গ্রাম, ডায়েট্রি ফাইবারঃ ৭৯ গ্রাম, প্রোটিনঃ ৮ গ্রাম।——সুত্রঃ ইন্টারনেট

এখন নিজেদের ভাবতে হবে কিভাবে কোন খাবারে আমাদের গরুগুলোকে সঠিক পুষ্টিগত খাদ্যমানে অভ্যস্ত করাবো আবার পাশাপাশি আমাদের জন্য সাশ্রয়ীও হবে। হুট করে খাবারের ম্যনু পরিবর্তন করলে ফলাফল ভালো আসবেনা, আপনি যা চান তা ধীরে ধীরে খাবারের ম্যনুতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমার এই পুরো লেখাটা হচ্ছে নতুনদের জন্য, আর তাদের জন্য যারা ডেইরী ব্যবসা করে লোকসান করছেন। একটা ব্যবসাকে লাভবান করতে হলেঃ আয়-ব্যয় এর পাকা হিসাব, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, দূরদর্শিতা থাকতে হবে।

বিঃদ্রষ্টব্যঃ ৫০০কেজি ওজনের ১টা গাভীর জন্য ৫কেজি শুকনো আঁশযুক্ত খড় & ১৫কেজি তাজা সবুজ আঁশযুক্ত ঘাস প্রয়োজন। আর দেশী ও সংকর জাতের গাভীকে সর্বোচ্চ ৬কেজি মিশ্র দানাদার খাবার & বিশুদ্ব বিদেশী জাতের গাভীকে সর্বোচ্চ ৮কেজি মিশ্র দানাদার খাবার দিলে চলবে। ১ম ৩কেজি দুধের জন্য প্রয়োজন ৩কেজি মিশ্র দানাদার খাবার & পরবর্তী ৩কেজি দুধের জন্য প্রয়োজন ১কেজি মিশ্র দানাদার খাবার।যদি দুধে স্নেহ জাতীয় পদার্থের পরিমান শতকরা ৪ভাগ পর্যন্ত থাকে।আর যদি দুধে স্নেহ জাতীয় পদার্থের পরিমান শতকরা ৪ভাগের উপরে থাকে তাহলে পরবর্তী আড়াই কেজি দুধের জন্য প্রয়োজন হবে ১কেজি মিশ্র দানাদার খাবার।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১১মার্চ২০