সব ধরনের মাছ চাষই লাভজনক। তবে এই শীতে অপেক্ষাকৃত কার্প জাতীয় মাছ চাষ করলে খামারিরা বেশি লাভবান হবেন। শীতকালে মাছের খিদে কম পায়। ফলে বৃদ্ধিও কম হয়। আবার মাছের রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তাই শীতকালে প্রয়োজন মাছের পরিচর্যা। সাধারণত জলাশয়ে শীতে মাছ চাষ হয় না।
পোনা মাছের বৃদ্ধি এ সময় কম হয়। আবার যাঁরা বাণিজ্যিক মাছের চাষ করেন তাঁরা শীতে পুকুর শুকিয়ে পরের বছরের চাষের জন্য প্রস্তুতি নেন। শীতের সময়ে পুকুরের বদ্ধ জলে মাছ চলাফেরা খুবই কম করে। দিন ছোট হওয়ায় রোদ অল্প সময় পুকুরের জলে পড়ে।
শীতকালে জলের তাপমাত্রা কমতে থাকে। সাধারণত তাপমাত্রা ২৮-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে মাছের বিপাক ক্রিয়া ভাল হয়। এর কম হলে বিপাক ক্রিয়া কমে যাওয়ায় বৃদ্ধির হার কমে। আবার রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছ সাধারণত ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নিচে খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেয়।
জলের তাপমাত্রা কম থাকলে শীতের মরশুমে ওই সব প্রজাতির মাছের বৃদ্ধি হয় না বললেই চলে। তাই অধিকাংশ মাছচাষিরা শীতে জলাশয়ে সম্পূর্ণভাবে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখেন। তবে এভাবে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখলে মাছ দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগে রোগাক্রান্ত হয় বহু মাছ। ফলে মাছের উৎপাদান ও ওজন অনেকটাই কম হয়।
তাই এই সময় সাইপ্রিনাস কার্প, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, আমুর কার্প প্রভৃতি প্রজাতির মাছ চাষের উপযুক্ত সময়। এই সব প্রজাতির মাছ ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও খাবার খেয়ে দ্রুত বাড়তে সক্ষম। এই সব মাছের ডিম পোনার দামও কম । বাঁচার হারও বেশি। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে অক্টোবর মাসেই চারা পোনা ছাড়ার সময়। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও এই মাছের চাষ করা যায়।
৬-৭ মাসের মধ্যে মাছ বিক্রির উপযুক্ত হয়ে পড়ে। শীতে গোটা জলাশয়ের অর্ধেকাংশে চাষ হয়, তাহলে ছোট-বড় সব রকম চাষিরই এসময় একটা লাভ পাবেন। পরে শীত কেটে গেলে ওই মাছ তুলে বাজারে বিক্রি করে রুই, কাতলা-সহ অনান্য মাছ চাষও করতে পারবেন।
আবার শীতে তাপমাত্রা কম থাকায় পুকুরে অ্যামোনিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। জলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় এবং অনেক সময় মাছ মরতে শুরু করে।
জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। পুকুরে উদ্ভিদকণার প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় জলে দ্রবীভূত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে মাছের শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। অক্সিজেনের অভাবে মাছ জলের উপরের দিকে ভাসতে থাকে। কৃত্রিম উপায়ে জলে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
জাল টেনে, সাঁতার দিয়ে এবং বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে জলে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এছাডা জাল টানার ফলে পুকুর থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস বেরিয়ে যায়। পাম্প মেশিন দিয়ে পুকুরের জলে ফোয়ারা করে বা আধুনিক এয়ারেটরের সাহায্যে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ালে এই সমস্যা দূর করা যায়।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মাছের খাবার স্বল্পতা দেখা দেয় ফলে দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। জলের পিএইচ (PH) স্বাভাবিক থাকে না। মাছের বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক পিএইচের মান সাড়ে সাত থেকে সাড়ে আটের মধ্যে থাকা উচিত। পুকুরের পাড় যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে।
শ্যাওলা, আবর্জনা, কচুরিপানা, আগাছা-সহ সব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর পাড়ে পাতা ঝরা গাছ থাকলে, গাছের পাতা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সর্বোপরি শীতের সময়ে মাছের মজুত ঘনত্ব কমাতে হবে। শীতে পুকুরের উপরি ভাগের তাপমাত্রা তলদেশের চেয়ে বেশি থাকে। সেই ক্ষেত্রে ফ্লোটিং ফিড প্রয়োগ করলে মাছ কম পরিমাণে হলেও খাদ্য গ্রহণ করে অপুষ্টি ও ওজন হ্রাস হতে রক্ষা পাবে।
শীতকালে পুকুরে পলিথিন শিট ব্যবহার একটি নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগ। পলিথিন শিট দিয়ে পুকুর ঢেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা নিয়ন্ত্রণ করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। তাই পলিথিন শিট দিয়ে পুরো পুকুর ঢেকে মাছের শীতকালীন সমস্যা রোধ-সহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন করা যেতে পারে। এছাড়া শীতে মাছ চাষের পরিচর্যার বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে ব্লক ও জেলা মৎস্য দপ্তরে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২২জুলাই২০