সারের প্রকারভেদ: সাধারণতঃ সার দুই প্রকার যথাঃ জৈব সার ও রাসায়নিক সার।
জৈব সার: প্রাকৃতিক ভাবে জীবদেহ হতে প্রাপ্ত অথবা প্রস্তুতকৃত সারকে জৈব সার বলা হয়। জৈব সারে গাছের খাদ্য উপাদান সমূহ সব সময় সমান মাত্রায় পাওয়া যায় না। নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার হলো খৈল, শুকনা রক্ত এসব; ফসফরাস সমৃদ্ধ জৈব সার হিসেবে হাড়ের গুড়া, মাছের গুড়া, খামারজাত সার, গোবর, গোচনা, হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা এসব; পটাশ সমৃদ্ধ জৈব সার হলো কচুরিপানার ছাই, কাঠের ছাই, কম্পোস্ট এসব; সাধারণ জৈব সার হিসেবে সবুজ সার, ধৈঞ্চা, শন, বরবটি, শুটি জাতীয় বিভিন্ন গাছ এসব। জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। জৈব সার ব্যবহারে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে। মাটির উর্বরতা বাড়ায়। মাটির উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। মাটিতে গাছের অনেক খাদ্য উপাদানের ঘাটতি পূরণ করে। বিশেষতঃ ইহা অনেক অনু খাদ্য উপাদানের যোগান দেয়। মাটির গঠন ও গুনাগুন উন্নত করে। ইহা বেলে মাটিকে সরস করে। মাটির পানি ধারন ক্ষমতা বাড়ায় ফলে সেচ পানির সদ্বব্যবহার হয়। মাটিতে ধীরে ধীরে কাজ করে বলে গাছ অনেক দিন তা থেকে পুষ্টি গ্রহন করতে পারে। জৈব সার পরবর্তী ফসলেও কাজে লাগে। মাটিতে অনুজৈবিক ক্রিয়া বেড়ে যায়। মাটিতে বায়ু চলাচল বেড়ে যায় ফলে মাটি ঝুরঝুরা হয় যা শিকড়ের বৃদ্ধিতে সহায়ক। গাছের অংগজ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। ভূমিক্ষয় সাধনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। জমিতে রাসায়নিক সার কম লাগে পাশাপাশি ইহা রাসায়নিক সারের কার্যকারিতাও বাড়াতে সাহায্য করে। মাটিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের আধিক্য জনিত বিষক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে, গুনগত মান বাড়ায় এবং গুদামজাত শস্যের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
রাসায়নিক সার: যে সব সার কৃত্রিম উপায়ে কারখানায় প্রস্তুত করা হয় তাকে রাসায়নিক সার বলে। রাসায়নিক সারে কাংখিত উপাদান সমূহ সব সময় সমান মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। প্রধান খাদ্য উপাদান ঘটিত রাসায়নিক সার হিসেবে ইফরিয়া, টিএসপি, এমওপি এসব। অপ্রধান খাদ্য উপাদান ঘটিত রাসায়নিক সার হিসেবে জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট এসব। অনুখাদ্য উপাদান ঘটিত রাসায়নিক সার হিসেবে বোরণ, জিংক সালফেট এসব।
রাসায়নিক সারে এক বা একাধিক মূখ্য উপাদান ছাড়াও গৌন বা অনুখাদ্য উপাদানও থাকতে পারে। রাসায়নিক গঠন অনুযায়ী সারকে আরোও তিনভাবে বিভক্ত করা যায়। যথা, মৌলিক সার ঃ যে সব রাসায়নিক সারে একটি মাত্র মূখ্য উপাদান থাকে তাদের মৌলিক সার বলে। যেমন, ইউরিয়াতে শুধু নাইট্রোজেন থাকে। যৌগিক সার ঃ যে সারে একাধিক মূখ্য উপাদান থাকে তাকে যৌগিক সার বলে। এতে সমপরিমান নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম থাকে। মিশ্র সার ঃ নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম এ তিনটি রাসাযনিক সারের যে কোন দুইটি বা তিনটি বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে সার তৈরী করা হয তাকে মিশ্র সার বলে। মিশ্র সার ফসলের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন অনুপাতে তৈরী করা হয।
জীবানু সার: বায়ু থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন ধারণে সক্ষম যে সব জীবানু বা অনুজীব শস্যের ফলন বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষায় নাইট্রোজেন ঘটিত সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায় উহাই জীবানু সার। এ সারের উপকারিতা জীবানু সার শুটি জাতীয় গাছের নাইট্রোজেনের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে। মাটিতে জৈব পদার্থে পরিমান বৃদ্ধি করে। মাটির উরবর্তা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মাটির উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের কৃষিতে সাধারণত ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বরিক এসিড ব্যবহার করা হয়। এ সারগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং ফসল উৎপাদনে তাদের প্রভাব নিম্নে ধারণা দেয়া হয়েছে।
ইউরিয়া সার: ইউরিয়া বহুল ব্যবহৃত নাইট্রোজেন সংবলিত রাসায়নিক সার। বিভিন্ন আকার আকৃতির এ সার সহজে পানিতে গলে যায়। দেখতে ধবধবে সাদা এ সার পুষ্টি উপাদানের চাবিকাঠি নাইট্রোজেন সরবরাহ করে থাকে। যা শিকড়ের বৃদ্ধি বিস্তার উৎসাহিত করে। সবুজ পাতা উৎপাদনে সহায়তা করে। আমিষ ও নিউক্লিক এসিড উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। ক্লোরোফিল উৎপাদনের মাধ্যমে গাছকে সবুজ বর্ণ দান করে। শর্করা উৎপাদন বাড়ায়। ফলের আকার বড় করতে সাহায্য করে। অন্যান্য সব আবশ্যক উপাদানের পরিশোষণ হার বাড়ায়। মাটিতে নাইট্রোজেন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে ক্লোরোফিল সংশ্লেষণের হার কমে যায়। ফলে গাছ স্বাভাবিক সবুজ বর্ণ হারিয়ে ফেলে। পাতার আকার ছোট হয় এবং শাখা প্রশাখার বৃদ্ধি হ্রাস পায়, ফলে গাছ খর্বাকার হয়। গাছের পাতা হালকা সবুজ থেকে হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে এবং অকালেই ঝরে পড়ে। ফুল ও ফলের আকার ছোট হয়। ফলন কমে যায়। নাইট্রোজেনের প্রয়োগ মাত্রা বেশি হলে গাছের কাঠামো ও গঠন দুর্বল হয়। ফুল ও ফল উৎপাদনে বিলম্বিত হয়। পোকামাকড় ও রোগ আক্রমণ বেড়ে যায়। পাতার অংশ ভারি হলে গাছ হেলে যায়।
টিএসপি ও ডিএপি সার: টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ও ডিএপি (ডাইএ্যামোনিয়াম ফসফেট)-এ দুটোই ফসফেট সমৃদ্ধ রাসায়নিক সার। টিএসপিতে শতকরা ১৩ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং ১.৩ ভাগ গন্ধকও বিদ্যমান থাকে। ডিএপিতে ফসফেট ছাড়াও ১৮% নাইট্রোজেন বিদ্যমান থাকে যার কারণে ইহা চুনযুক্ত পলি মাটির জন্য একটি উত্তম সার। টিএসপি সারের রঙ ধূসর থেকে গাঢ় ধূসর হয়ে থাকে। এ সারে অম্লস্বাদযুক্ত ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে। ডিএপি সারের রঙ সাধারণত সাদাটে থেকে গাঢ় ধূসর হয়ে থাকে। ডিএপিতেও অম্লস্বাদযুক্ত ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে। ফসফরাস কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করে। শর্করা উৎপাদন ও আত্তীকরণে সাহায্য করে। শিকড়ের বৃদ্ধি বিস্তার উৎসাহিত করে। গাছের কাঠামো শক্ত করে এবং নেতিয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ রোধ করে। ফুল, ফল ও বীজে গুণগতমান বাড়ায়। মাটিতে ফসফরাসের ঘাটতি হলে কা- এবং মূলের বৃদ্ধি হ্রাস পায়। পার্শ্বীয় কা- এবং কুড়ির বৃদ্ধি কমে যায়। ফুলের উৎপাদন কমে যায়। পাতার গোড়া রক্তবর্ণ অথবা ব্রোঞ্জ রঙ ধারণ করে। পাতার পৃষ্ঠভাগ নীলাভ সবুজ বর্ণ ধারণ করে। পাতার কিনারে বাদামি বিবর্ণতা দেখা যায় এবং শুকিয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় । ফসফরাসের পরিমাণ অধিক হলে ফলন কমে যায়। গাছে অকাল পরিপক্বতা আসে। গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।
এমওপি সার: এমওপি বা মিউরেট অব পটাশ সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি পটাশ সার। এ সারে শতকরা ৫০ ভাগ পটাশ থাকে। এ সার সহজে পানিতে গলে যায় বা দ্রবীভূত হয়। এ সারের রঙ সাধারণত সাদা থেকে হালকা বা গাঢ় লালচে রঙের এবং এর আকৃতি ছোট থেকে মাঝারি আকারের স্ফটিকাকৃতির হয়ে থাকে। উদ্ভিদে শ্বেতসার দ্রব্য স্থানান্তরে বা পরিবহনে সহায়তা করে। লৌহ ও ম্যাংগানিজের কার্যকারিতা বাড়ায়। আমিষ উৎপাদনে সাহায্য করে। উদ্ভিদে পানি পরিশোষণ, আত্তীকরণ ও চলাচল তথা সার্বিক নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গাছের কাঠামো শক্ত করে। নাইট্রোজেন ও ফসফরাস পরিশোষণে সমতা বিধান করে। পটাশের ঘাটতি হলে পুরাতন পাতার কিনরা হতে বিবর্ণতা শুরু হয়। গাঢ় নীল বর্ণের পাতা দেখা যায়। পাতার আন্তঃশিরায় বাদামি বর্ণের টিস্যু হতে দেখা যায়। পাতার উপরিভাগে কুঞ্চিত হতে বা ভাঁজ পড়তে দেখা যায়। গাছ বিকৃত আকার ধারণ করে। পোকামাকড় ও রোগবালাই এর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। পটাশের সরবরাহ বেশি হলে ক্যালসিয়াম ও বোরনের শোষণ হার কমে যায়। গাছের বৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।
জিপসাম সার: জিপসাম সারে শতকরা ১৭ ভাগ গন্ধক এবং ২৩ ভাগ ক্যালসিয়াম বিদ্যমান থাকে। এ সারের নমুনায় আর্দ্রতা বেশি থাকায় তা বেশি দিন বস্তায় সংরক্ষণ করা যায় না। প্রকৃত জিপসাম সার আলোতে কিছুটা চিক চিক করে এবং এ সারের হস্তানুভূতি কোমল প্রকৃতির। এ সার সাদাটে বা ধূসর বর্ণের পাউডারের মতো। গন্ধক আমিষ উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। ক্লোরোফিল গঠনে সাহায্য করে। গাছের বর্ণ সবুজ রাখে। বীজ উৎপাদনে সাহায্য করে। ফসলের গুণগতমান বাড়ায়। মাটিতে গন্ধকের অভাব হলে গাছের সবুজ বর্ণ বিনষ্ট হয়, কা- সবুজ ও চিকন হয়। পাতা ফ্যাকাশে সবুজ বা হলুদ আকার ধারণ করে। গাছে শর্করা এবং নাইট্রোজেন বৃদ্ধি পায়। জিপসাম প্রয়োগের মাত্রা বেশি হলে শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায়। শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
বোরণ সার: বরিক এসিড ও সলুবর সার বোরণ ঘাটতি এলাকায় বহুল ব্যবহৃত বোরণ সার। বরিক এসিডের রঙ সাদা। ইহা অনিয়তিকার এবং স্ফটিকাকৃতির। গরম পানিতে সম্পূর্ণ গলে যায়। সলুবর সার বোরণ ঘাটতি এলাকায় জন্য একটি উৎকৃষ্ট বোরণ সার। এটি দেখতে ধবধবে সাদা, হালকা, মিশি পাউডারের মতো, ঠা-া পানিতে সলুবর সম্পূর্ণ গলে যায় এবং পাত্রে কোনো ধরনের তলানি পড়ে না। বোরণ পুষ্টি উপাদান গাছের কোষ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পাতা ও ফুলের রঙ আকর্ষণীয় করে। পরাগরেণু সবল ও সুস্থ রাখে। বীজ উৎপাদনে সহায়তা করে এবং চিটা রোধ করে। বোরণের ঘাটতিতে গাছের অগ্রভাগ মরে যায়, কা- কালো বর্ণ ধারণ করে। শিকড় বৃদ্ধি হ্রাস পায়। কোষ প্রাচীর ভেঙে যায়। গাছ মচ মচ ভাব ধারণ করে। বোরণের প্রয়োগ মাত্রা বেশি হলে কচি পাতা এবং ডগা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলন অনেক কমে যায়।
সার প্রয়োগের কিছু সাধারণত নীতিমালা
সার প্রয়োগে নিম্নে বর্ণিত সাধারণ নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত: রাসায়নিক সার কোন বীজ, নতুন শিকড় ও গুল্ম জাতীয় গাছের কান্ডের অতি সন্নিকটে বা কোন ভেজা কচি পাতার ওপর ব্যবহার করা উচিত নয়। ঘনীভূত লবণ বিধায় এগুলো গাছের নাজুক সকল বাড়ন্ত অংশকে পুড়িয়ে দিতে পারে। সার যতদূর সম্ভব ভালভাবে মাটির সংগে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার দাড়ানো বেশী গভীর পানিতে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। এতে, বেশীর ভাগ নাইট্রোজেন অপচয় হতে পারে। জিঙ্ক ও ফসফেট সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। কেননা, এ উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ফসল তা গ্রহণ করতে পারে না। জৈব সার ফসল বপন/রোপনের কমপক্ষে ৭-১০ দিন পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সারের (ধৈঞ্চা) পর ধান চাষ করতে গেলে যতশীঘ্র সম্ভব ধানের চারা রোপণ করতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মিশানোর ৭ দিন পর ধানের চারা রোপণ করতে হবে। গৌণ উপাদানের দ্রবণ পাতায় সিঞ্চন করা যেতে পারে (বিশেষ করে উদ্যান ফসলের ক্ষেত্রে)। সাধারণ ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইফরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশী ফসল পাওয়া যায়। গুটি ইউরিয়া পরিমাণে শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে। মৌসুমে একবার ব্যবহার করতে হয়। যে জমিতে পানি কম চুষে যায়, কেবল সে জমিতেই ব্যবহারযোগ্য।
সারের ফলপ্রদ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমিতে তিন পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা হয়। হাতে ছিটানো, স্থানীয় প্রয়োগ এবং পাতায় বা পল্লব গুচ্ছে সিঞ্চন। হাতে ছিটানো পদ্ধতি সাধারণত মাঠ ফসলে এবং স্থানীয় প্রয়োগ সাধারণত ফল বাগান ও সবজিতে করা হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য ফসল ও মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ নির্দেশাবলী অনুসরণ করা উচিত। নিয়মাবলীগুলো হলো রবি মৌসুমে সেচের সুবিধা না থাকলে, জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ইউরিয়া পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করে তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে, ইউরিয়া ৩ অংশে ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিৎ। প্রথম অংশ শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ফসলের দ্রুত আঙ্গিক বৃদ্ধির সময় দ্বিতীয় বার এবং কাঁইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে তৃতীয় ও শেষবার ইফরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। বোনা আমন ছাড়া অন্যান্য ধান চাষের বেলায় ইউরিয়া সমান ৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হয়। রোপা ধানের বেলায় শেষ চাষে বা ধানের চারা মাটিতে লেগে যাওয়ার পরপরই (আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করে) প্রথমবার ইউরিয়া প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হয়।
বোনা ধান চাষের বেলায় কুশি বের হওয়ার পূর্বে প্রথম দফার ইউরিয়া ছিটিয়ে দিয়ে তা ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এ সময় মাটি উত্তমরূপে ভেজা থাকা দরকার। দ্রুত কুশি বের হবার পর্যায়ে অথবা দ্বিতীয়বার আগাছা বাছাইয়ের সময় উপরিপ্রয়োগ হিসেবে দ্বিতীয় দফা ইউরিয়া প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। কাঁইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে, পুরোপুরি ভেজা মাটিতে বা সামান্য দাড়ানো পানিতে ইউরিয়া ৩য় বার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। শাক সবজি চাষের বেলায় ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউরিয়া ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগকরা যায়। স্বল্প মেয়াদি ফসলের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের পুরোমাত্রা শেষ চাষের সময়েই প্রয়োগ করা যায়। অধিকাংশ মশলার ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। ভেজা মাটি অথবা জো আসা মাটিতে পড়ন্ত বিকেলে ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিলে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যায়।
তবে তা ধানের শিষ বের হওয়ার পূর্বেই করতে হয়। ফসফেট সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা উচিত এবং দস্তা সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ ও গন্ধক জাতীয় সারগুলো একবারে প্রয়োগ করা চলে। তবে, মোটা বুনটযুক্ত মাটিতে পটাশ সার দু’ভাগে ভাগ করে ব্যবহার করা যায়। প্রথম ভাগ, জমি তৈরির শেষ সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ, দ্রুত কুশি বের হওয়ার সময় প্রয়োগ করতে হবে। তামাক ও রসুন ফসলে এমওপি সার ব্যবহারের পরিবর্তে পটাসিয়াম সালফেট সার ব্যবহার করতে হবে। সালফার এবং জিংক সারের সুপারিশকৃত মাত্রা শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা না হলে প্রয়োজনবোধে এগুলো উপরিপ্রয়োগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। সময়মতো ইউরিয়া প্রয়োগের পরেও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে তা সালফারের ঘাটতি বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যত শীঘ্রই সম্ভব সুপারিশকৃত সালফার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। কচি পাতা সাদা হয়ে গেলে (গোড়ার দিক থেকে ক্রমশ ডসার দিকে) এবং সে সঙ্গে পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামী রংয়ের ছিট দেখা দিলে, তা জিঙ্ক সারের ঘাটতির ইঙ্গিত করে। এরূপ লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষনিকভাবে অনুমোদিত পুরো মাত্রায় জিঙ্ক সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। মিশ্র ফসলে সার প্রয়োগের বেলায় ঐ ফসলের একক ফসলের পদ্ধতির মতোই হবে।
রাসায়নিক (অজৈব) সার পাতায় প্রয়োগঃ
পাতায় সার প্রয়োগঃ
নির্দিষ্ট পরিমান রাসায়নিক সার পরিমিত পানির সাথে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে বর্ধনশীল গাছের পাতায় স্প্রে করা যায়। পাতায় স্প্রের মাধ্যমে সারের সাশ্রয় প্রাধান্য থাকে না বরং প্রাথমিক পর্যায়েই গাছে পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিলে, মাটির ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থা খারাপ হলে এবং খরার সময় যখন সেচের অভাবে মাটিতে আর্দ্রতা থাকে না তখনই স্প্রে করার উপযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। পাতায় সার ¯েপ্র করার কিছু অসুবিধাও আছে যেমন দ্রবণের ঘনত্ব বেশী হলে পাতার কিনারা পুড়ে যেতে পাওে বা দগ্ধ হয়ে ঝল্সে যেতে পারে। যেহেতু কম ঘনত্বেও দ্রবণ স্প্রে করতে হয় (সাধারণত ৩-৬%) সেহেতু এশবার স্প্রে মাধ্যমে অল্প পরিমান পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা যায়। সারের মধ্যম থেকে বেশী মাত্রার ক্ষেত্রে অনেকবার স্প্রের প্রয়োজন হয়।
সুবিবেচক হিসেবে সার প্রায় প্রয়োগ:
ফসলের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হলে, মাটি পরীক্ষা করে সার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া অনলাইন ফার্টিলাইজার সুপারিশ নির্দেশনা মেনেও সার প্রদান করা যায়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ফসল নাইট্রোজেন বেশি মাত্রায় খায়, লস হয় এবং মাটিতে কম থাকায় প্রতি বছর প্রতি মৌসুমেই ইফরিয়া সার নাইট্রোজেনের জন্য পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়। রবি মৌসুমে পূর্ণমাত্রায় ফসফরাসের জন্য টিএসপি প্রয়োগ করলে জমির মাটিতে কিছুটা ফসফরাস অবশিষ্ট থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে ধান, পাট ফসলে মোট মাত্রার ৪০-৫০% কম লাগে। সবজি ফসলের জন্যও ৩০-৫০% কম লাগে। রবি মৌসুমে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ এমওপি সার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করলে পরবর্তী ফসলে ফসলভেদে ৩০-৪০% সার কম লাগে। সালফার সারের ক্ষেত্রে রবি ফসলে পূর্ণমাত্রা দেওয়ার পর পরবর্তী ফসলের জন্য ভিজা জমিতে সবসময় পূর্ণমাত্রায় সার দিতে হবে এবং শুকনা মাটি হলে ৫০% সার দিলেই চলবে। জিংক সারের ক্ষেত্রে অর্ধেক ডোজ পরিমাণ দিলেই চলে। তাছাড়া বোরণ সার ফসলের জমিতে বছরে এশবার দিলেই চলে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সার ব্যবহারের প্রমীত সুপারিশ
প্রতিটি উপজেলায় মৃত্তিকা পরীক্ষা গবেষণাগার স্থাপন করা, প্রতিটি কৃষককে মাটির স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান, প্রতিটি কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা নিশ্চিত করা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান সহ সার (ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০০৬ মোতাবেক বিনির্দেশিত বিধানাবলী যথাযথ উদ্যোগ নেয়া ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার কৃষি উপকরণ তথা সারে বিশাল বাজেটের ভর্তুকি প্রদান করে যাচ্ছে। রাসায়নিক সারের আকাশচুম্বী দামের অবস্থা থেকে কৃষকের হাতের নাগালে আনয়নে বারবার দাম কমিয়েছে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ অধিকতর ফসল উৎপাদন, শস্য বহুমুখীকরণ, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য পরিমিত মাত্রায় জমিতে সার ব্যবহার করা উচিত। এ ব্যাপারে কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল কৃষি কর্মী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদদের কাজ করতে হবে। সর্বোপরি কৃষকরা নিজেরাও এগিয়ে আসবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/৩০মার্চ২০