টিস্যু কালচার ব্যবহার করে কম জমিতে অধিক আলু উৎপাদন

1916

১-1
আলু চাষে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে টিস্যু কালচার পদ্ধতি। আর এই টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত ব্র্যাক সিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো এন্টারপ্রাইজের আলু বীজ রোপণ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আলু চাষিরা। বিগত কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙে এবার প্রতি বিঘায় ডায়ামান্ট জাতের আলু উৎপাদন হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ মণ হারে। তাই কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে এই বীজ আলু।

উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়নের দক্ষিণ আমইন গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, তিনি বংশ পরম্পরায় একজন কৃষক। প্রতিবছরই কম-বেশি আলু চাষ করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি মৌসুমে ৩০ বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছেন। সব জমিতেই টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত ব্র্যাকের আলু বীজ রোপণ করেন। এরই মধ্যে জমি থেকে আলু উত্তোলন শুরু করেছেন। প্রতি বিঘায় আলু উৎপাদন হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ মণ হারে। এই চাষি আরও বলেন, বাজারে আলুর দাম কম। এরপরও ফলন ভালো হওয়ায় সব খরচ বাদে বিঘাপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। জামুন্না হাটখোলা এলাকার আলহাজ ফরিদ উদ্দিন বলেন, এর আগে বাজারের প্রচলিত বীজে আলু চাষ করে তিনি ফলন পেয়েছিলেন বিঘাপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ মণ। আর টিস্যু কালচার পদ্ধতির বীজে এবার ৪০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেন তিনি। প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ১১৫ মণ হারে। বিষয়টি অনেকটা অবাস্তব মনে হলেও প্রকৃত সত্য এটিই। এছাড়া টিস্যু কালচার বীজে যে কোনো ধরনের আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা থাকে বলে এই আলু চাষি জানান।

ব্র্যাক সিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক কৃষিবিদ এম এ মুনছুর লিয়ন বলেন, টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত তাদের আলু বীজ রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল এবং ভাইরাসমুক্ত। তাই তেমন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। এছাড়া বাজারে প্রচলিত বীজ আলুর তুলনায় অধিক ফলনশীল। একর প্রতি ১২ থেকে ১৬ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে বলে এই কর্মকর্তা দাবি করেন। কৃষিবিদ এম এ মুনছুর লিয়ন আরও বলেন, তারা এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত ডায়ামান্ট, কার্ডিনাল, গ্রানোলা ও এস্টারিক্স জাতের বীজ আলু কেবল বাজারজাত করে থাকেন। এরই মধ্যে তাদের বীজ আলু চাষিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় ৩ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষ হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। তবে মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও বাম্পার ফলন হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
কারণ চাষিরা সবাই টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ আলু জমিতে লাগিয়েছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খাজানুর রহমান বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলো গবেষণা করে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবন করছেন। বিশেষ করে আলু চাষে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে টিস্যু কালচার পদ্ধতি। এই পদ্ধতির বীজ আলু রোপণ করে চাষিরা সফলতাও অর্জন করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত আলুবীজ মাঠ পর্যায়ের কৃষক ও বিভিন্ন কৃষি উপকরণ তৈরি প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ব্র্যাক সিড অ্যান্ড অ্যাগ্রো এন্টারপ্রাইজ অন্যতম বলে এই কৃষি কর্মকর্তা জানান।

ষাটের দশকে হল্যান্ডের আলু বাংলাদেশে আমদানি হয়ে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা বেড়েছে বিদেশে। রফতানি হচ্ছে ভিয়েতনাম, রাশিয়া, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ২৮টি দেশে। গত পাঁচ বছরে আলু রফতানি অন্তত দশগুণ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আলু রফতানি হয় সাড়ে ৯ হাজার মে.টন। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ টনে।

কৃষির বীজ বিভাগ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আলুর ৭১টি জাতের বীজের ছাড়পত্র মিলে অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্ভাবিত জাত ১৩টি। বাকি জাত দেশের বিভিন্ন কোম্পানির। যা এসেছে বিদেশ থেকে। বেশিরভাগ জমিতে আবাদ হচ্ছে কার্ডিনাল, এসটারিক্স, ডায়মন্ড, গ্র্যানুলা, বিনেলা, লেডি রোজেটা, কারেজ, এটলাস, বেলিনি, বেলারুশ, আটলান্টিক বিভালাডি, রেড ফ্যান্টাসি ইত্যাদি। এর সঙ্গে বারি উদ্ভাবিত আলু বারি-৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫৬, ৫৭, ৬২, ৬৩ জাত মাঠে আবাদ পর্যায়ে রয়েছে।

আলু আবাদে মাঠের কৃষক এখন অনেক দক্ষ। তারা আগাম আলু উৎপাদনের পাশাপাশি নতুন জাত সংগ্রহ করে। বীজ সংগ্রহে টিস্যু কালচারের মতো উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখেছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রের খবর- দেশে আলু বীজের চাহিদা অন্তত ৭ লাখ মে.টন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বেসরকারী সংস্থা ও কৃষকের ঘরে যে বীজ আছে তা দিয়ে এবারের চাহিদা মিটবে, এমনটি আশা কৃষি অধিদফতরের। বিএডিসি জানিয়েছে, সরকার আলু চাষে গুরুত্ব দিয়েছে। বীজ সার উপকরণ সময়মতো দেশের প্রতিটি এলাকায় পৌঁছানো হয়েছে। গুণগতমানের বীজ সংরক্ষণে বিএডিসির আওতায় রয়েছে ২৫টি হিমাগার। খাবার আলু সংরক্ষণে দেশজুড়ে বেসরকারী পর্যায়ে রয়েছে ৪শ’রও বেশি হিমাগার। আলু রফতানিকারকরা তাদের বিশেষায়িত হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করছে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪জানু২০২০