বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত। বাংলাদেশে এ ধরনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি ইউনিটও সৃষ্টি করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে অধিকতর মাত্রায় খাদ্যশস্য উৎপাদনও জরুরি। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বছরের অভিজ্ঞতা আশাব্যঞ্জক হয়নি। কারণ প্রথমে হাওরাঞ্চলে বন্যা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হাওরে হঠাৎ বন্যা ও অন্যান্য অঞ্চলেও বন্যা হয় বলে অনেকে মনে করেন। আবহাওয়া দপ্তরও এমনটিই আভাস দিয়েছিল। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা-২-এর জন্য বড় ধরনের বাধা। লক্ষ্যমাত্রা-২-এ করা টেকসই কৃষি উন্নয়নের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছর বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও শ্রীলংকায় বন্যা হয়। কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণের জন্য শস্যের ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে শস্য বীমার বিষয়টি এখন প্রাধান্য পেয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও এ খাতে বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর কিছু উদাহরণও জানা গেছে।
২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর বিশ্বব্যাংক গ্রুপের গ্লোবাল ইনডেক্স ফ্যাসিলিটির (জিআইআইএফ) উদ্যোগে শ্রীলংকায় একটি কর্মশালা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষি বীমা খাতে উদ্ভাবনীমূলক পদক্ষেপের সূচনা করা। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট একটি প্রকল্প ২০১৫ সালে গ্রহণ করা হয়।
ভারতে মোদি সরকার সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’ শীর্ষক একটি উদ্যোগের সূচনা করেছে। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কারণে কৃষি তথা শস্য বীমার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এশিয়ায় বেশিরভাগ অঞ্চলেই শস্য বীমা প্রথা চালু করা হয় অনেক আগে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষেত্রে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কারণ শস্য বীমা প্রথা অনেক আগে চালু করা হলেও সে চেষ্টা সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা উল্লেখযোগ্য।
ভারতে শস্য বীমা চালুর পরীক্ষামূলক প্রকল্প ১৯২০ সালে গ্রহণ করা হলেও এ ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের পরে বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সর্বশেষ হলো ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’। এ উদ্যোগও বর্তমানে প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতের অডিটর জেনারেল ও অন্যান্য নিরপেক্ষ বেসরকারি সংস্থার মূল্যায়নে বলা হয় যে, এ উদ্যোগের ফলে কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পায়নি বরং সংশ্নিষ্ট বীমা সংস্থারা প্রায় ১০ হাজার কোটি (রুপি) লাভ হিসাবে পেয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শস্য বীমার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলা করার উদ্যোগ লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, সাম্প্রতিককালে হো চি মিন সিটিতে একটি কর্মশালাও করা হয়। জানা যায়, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে সরকারি ভর্তুকিপুষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত শস্য বীমা প্রথা চালু রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় এ খাতে প্রকল্প রয়েছে। কম্বোডিয়ায় এখন দেশব্যাপী শস্য বীমা চালু হয়নি। মিয়ানমারে অচিরেই শস্য বীমা চালু করা হবে বলে জানা গেছে। যে প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে মুখ্য তা হলো, শস্য বীমা প্রথা জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক আগেই যদি চালু হয়ে থাকে, তাহলে নতুন আর কি। এর উত্তর হলো, সাম্প্রতিককালে শস্য বীমার ক্ষতি নিরৃপণের জন্য আবহাওয়ার তারতম্য অঞ্চলভিত্তিক প্রথা অবলম্বন করা হচ্ছে। এই প্রথায় কৃষকদের ক্ষতি নিরৃপণ করা সহজতর বলে অনেকে দাবি করেন। কারণ বীমার আওতাধীন প্রতি কৃষকের ক্ষতি নিরৃপণ করা একটি দুরৃহ, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। এছাড়া এ প্রথার ফলে ক্ষতিপূরণের জন্য যোগ্য নয় এমন কৃষক ক্ষতিপূরণ পাবে না। তবে এর বিপরীত দিকও বিবেচনাযোগ্য। তাহলো কৃষকপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। এ কারণে যে কৃষকের বেশি ক্ষতি হয়েছে, সে কম ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেলে ক্ষুব্ধও হতে পারে।
সাধারণ বীমা করপোরেশন ১৯৭৭ সালে পরীক্ষামূলকভাবে শস্য বীমা চালু করেছিল। প্রথমে বিআরডিবির নিবন্ধনকৃত কৃষক সমবায় সমিতি শস্য বীমাভুক্ত ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত কৃষিঋণ যেসব কৃষক গ্রহণ করেছেন, তাদেরও বীমার আওতায় আনা হয়।
জানা মতে, শস্য বীমা ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় এ উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণ বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়। প্রধান কারণগুলো হলো- এক. যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণের অভাবসহ সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই তাড়াহুড়া করে প্রকল্প চালু করা; দুই. কৃষিঋণ প্রথার সঙ্গে এর কোনো সংযোগ না করা; তিন. এ উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সহায়তা না থাকা; চার. বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন না করেই প্রকল্পের আকার বৃদ্ধি; পাঁচ. শস্য বীমা কর্মসূচি ঐচ্ছিক ও ব্যক্তিভিত্তিক থাকার কারণে সুবিধাভোগী নির্বাচনে ভুলত্রুটি ছিল; ছয়. দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে শস্য ঋণ মওকুফে রাজনৈতিক প্রবণতা ছিল ব্যর্থতার অন্যতম কারণ এবং সাত. বীমার আওতাধীন বিষয় একাধিক ছিল বন্যা, শিলাবৃষ্টি, খরা, রোগবালাই। এর ফলে বীমা কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়ে।
শস্য বীমা প্রকল্পের ব্যর্থতার উত্তরণের বিষয়ে ১৯৯৪ সালে সংশ্নিষ্ট সংসদীয় কমিটি কয়েকটি সুপারিশ করে, যা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সুপারিশের মধ্যে ছিল- ক. সরকার ও ঋণদানকারী সংস্থা বীমার প্রিমিয়ামের একাংশ বহন করবে; খ. ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ব্যয় তহবিল গঠন করতে হবে এবং গ. ব্যক্তিভিত্তিক ক্ষতিপূরণের প্রথার পরিবর্তে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষতিপূরণের প্রথা চালু করতে হবে।
১৯৯৪ সালে প্রদত্ত উপর্যুক্ত সুপারিশের আদলেই বর্তমানে আবহাওয়া সূচক অঞ্চলভিত্তিক ক্ষতিপূরণের মডেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৯৯৪ সালের সুপারিশের অন্যতম বিষয় ছিল ব্যয়ভার বহনে সরকার ও ঋণদানকারী সংস্থাদের অংশীদারিত্ব এবং বীমা তহবিল গঠন। এ ধরনের সুপারিশ বাস্তবসম্মত হলেও এখন পর্যন্ত অর্থাৎ ২৩ বছরেও কোনো সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শ্রীলংকা একটি জাতীয় বীমা ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিলে অনুদান হিসেবে নিবন্ধিত ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক সংস্থার লভ্যাংশের এক শতাংশ জোগান দিত। ২০১৬ সালে শ্রীলংকা সরকার ঋণ সুরক্ষা কর্মসূচিও চালু করেছে। জাতীয় বীমা তহবিল থেকেই এর ব্যয়ভার বহন করা হয়।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এ প্রথার আওতায় সংশ্নিষ্ট ব্যাংকদের ৫০০ মিলিয়ন রুপি দিতে হবে, যা কৃষিঋণের ব্যয়ভার হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের এক শতাংশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ প্রায় পাঁচ বিলিয়ন রুপি, যার বিপরীতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩.৯ বিলিয়ন রুপি। এ অর্থ শস্য বীমা ব্যয়জনিত। এছাড়া আরও ৫০০ মিলিয়ন ঋণ সুরক্ষা খাতে ব্যয় হবে।
পূর্ব এশিয়ায় অর্থাৎ আসিয়ান জোটভুক্ত কয়েকটি দেশের শস্য বীমা সংক্রান্ত গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদনের যে বিরাট হুমকি রয়েছে, তা একমাত্র শস্য বীমা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বহুবিধ হুমকির জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থার প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র ২০টি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে শস্য বীমা প্রকল্প চালু হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শস্য বীমা পলিসির বিপরীতে ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৬৩০ টাকা ভ্যাটসহ অর্জিত হয়েছে। পরীক্ষামূলক শস্য বীমায় ভ্যাট স্থগিত করাই হয়তো ভালো হতো। মোট পাঁচ হাজার ৬৪২টি পলিসির বিপরীতে উত্থাপিত দাবি ৫০ লাখ ৩৭ হাজার ৪১৪ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ টাকার ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ ঘাটতি হয়তো প্রকল্প তহবিল থেকে মেটানো হবে। প্রকল্প শেষ হলে কী হবে? ১৯৭৭ সালের পর যে শূন্যতা এসেছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে কি? সূত্র: সমকাল অনলাইন।
লেখক: এএমএম শওকত আলী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম