সারা বিশ্বে তুলা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আঁশ জাতীয় ফসল। এদেশে তুলা উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত এদেশে তুলা উৎপাদনের পরিমান তেমন বেশি নয়। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সক্রিয়তায় বর্তমানে তুলা উৎপাদনের জমির পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তুলা চাষের উপযোগী জমি ঃ তুলা চাষের জন্য উৎকৃষ্ট মাটি হল দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ। তবে পর্যাপ্ত জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ যেকোন মাটিতেই তুলার চাষ করা যায়। খুব বেশি বেলে বা কর্দমকণা সমৃদ্ধ মাটি তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। যেসব জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়িয়ে থাকে না বা স্বাভাবিক বন্যার পানি উঠে না এরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। যে জমি স্যাঁতসেঁতে, ছায়াযুক্ত এবং যেখানে বৃষ্টির পানি ২-৬ ঘন্টার মধ্যে নেমে যায় না সেরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়। মাটির পিএইচ মান ৬.০-৭.৫ হওয়া উত্তম। মাটি বেশি অম্লীয় হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
জমি তৈরি: আমাদের দেশে বর্তমানে উন্নত পদ্ধতিতে তুলা চাষ করা হচ্ছে এবং এই সময়কাল হল বর্ষাকাল। বর্ষার অবস্থা বুঝে মাটিতে ‘জো’ থাকা অবস্থায় ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল করে জমি তৈরি করতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়িয়া অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে তুলা চাষ করা হয়। পক্ষান্তরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তুলার চাষ করা হয়। দেশের যে সমস্ত অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান কম, সে সমস্ত অঞ্চলে শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে জমি চাষ করে বীজ বপন করা হয়। এদেশের রংপুর-দিনাজপুর এলাকায় শ্রাবণ মাসের মধ্যেই বীজ বপন করা হয় এবং অন্যান্য সমতল অঞ্চলে ভাদ্র মাসে জমি তৈরি করে বীজ বপনের উপযুক্ত করা হয়।
বীজ বপনের সময়: আগাম শীত এলাকায় ( বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর এলাকা) শ্রাবণ মাস হতে ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই বীজ বপনের কাজ শেষ করতে হবে। পাহাড়িয়া এলাকায় বর্ষা তীব্র আকারে শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্বে (জমিতে ‘ জো’ থাকা অবস্থায়) বীজ বপন করা উত্তম। অর্থাৎ খরা মৌসুমে তুলা আবাদের জন্য জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজ বপন করতে হবে। উত্তরবঙ্গ ও পাহাড়িয়া এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় শ্রাবণের মাঝামাঝি হতে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য শ্রাবণের দিকে বীজ বপন উত্তম। যদি কোথাও বিশেষ কারনে বীজ বুনতে দেরি হয় তবে তা অবশ্যই ভাদ্রের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
বীজ প্রক্রিয়াজাতকরন: বপনের সুবিধার জন্য তুলাবীজ ৩-৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে তা ঝুরঝুরে মাটি বা শুকনো গোবর অথবা ছাই দিয়ে এমনভাবে ঘষে নিতে হবে যেন আঁশগুলো (ফাঁজ) বীজের গায়ে লেগে না থাকে এবং বীজ একটা হতে অন্যটা আলাদা হয়ে যায়। এছাড়া লঘু সালফিউরিক এসিড দিয়ে বীজ আঁশ মুক্ত করেও বপন করা যায়। এতে বীজের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবানু ও পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
বীজের হার ও বপনের পদ্ধতি: বীজের হার: তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ওপি জাতের ক্ষেত্রে প্রতি একরে প্রায় ৩ কেজি এবং হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ১.৫-১.৮ কেজি বীজ দরকার হয়।
বপন পদ্ধতি: উত্তর-দক্ষিন লাইন করে সারিতে বীজ বপন করা উত্তম। হাত লাঙল দিয়ে হালকাভাবে সারি টেনে অনুমোদিত সার প্রতি সারিতে ভাল করে নিয়ে তা প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর নির্ধারিত দূরত্ব ১.২৫ সেঃ মিঃ থেকে ২.৫ সেঃ মিঃ গভীরে ৩/৪টি বীজ বুনে তা ঢেকে দিতে হবে। সিবি – ১ সারির দূরত্ব – ১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫০-৬০ সেঃ মিঃ। অন্য সকল জাত সারির দূরত্ব – ৯০-১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫-৫০ সেঃ মিঃ।
তুলা ফসলের অন্যান্য পোকামাকড়ের মধ্যে জ্যাসিড, জাব পোকা ও তুলার পাতা মোড়ানো পোকার উপদ্রব দেখা যেতে পারে। এসব পোকার আক্রমন সহজভাবে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে অনুমোদিত ঔষধ মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
তুলা গাছে বেশ কয়েকটি রোগের প্রার্দুর্ভাব দেখা দিতে পারে; যথা- পাতা ঝলসানো, এনথ্রাকনোজ, নেতিয়ে পড়া, চারা ধসা ইত্যাদি। বীজবাহিত রোগের জন্য বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। রোগাক্রান্ত চারা তুলে পুড়িয়ে ফেলা উত্তম। জমিতে পানিবদ্ধতা থাকতে দেয়া যাবে না। রোগাক্রমণের সম্ভবনা আছে এমন ক্ষেতে ৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২.৫% ডাইথেন-এমএ ৪৫ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তুলা সংগ্রহ: তুলা গাছের বোল ভালভাবে ফেটে বের হলে পরিষ্কার শুকনা দিনে বীজতুলা উঠাতে হয়। সাধারণত ৩ বারে ক্ষেতের তুলা উঠাতে হয়। প্রথমবার এমন সময় তুলা উঠাতে হবে যেন মোট ফলনের ৪০%-৫০% তুলা উঠানো যায়। দ্বিতীয় কিস্তি ও তৃতীয় কিস্তিতে যথাক্রমে ২৫% বা ৩০% এবং অবশিষ্ট তুলা উঠাতে হয়। সাধারণত প্রথমবারের তুলা ভাল হয়। তাই প্রথমবারের তুলা আলাদা রাখতে হয়। তুলা উঠানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে ময়লা, মরা পাতা ও পোকায় আক্রান্ত খারাপ অপুষ্ট তুলা যেন ভাল তুলার সাথে মিশে না যায়। ভাল তুলা পৃথক করে তা ৩/৪ দিন ভাল করে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।
ফলন: স্বভাবিক অবস্থায় কৃষকের সক্রিয়তা থাকলে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কুইন্টাল বীজ তুলা উৎপন্ন হয়। তবে যথাযথ উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বনে তুলা চাষ করলে ফলন এর দ্বিগুন পাওয়া যায় বলে জানা গেছে।
তুলা বলতে বীজ হতে উৎপন্ন আঁশকে বুঝায়। বীজের বহিঃত্বকের কিছু কোষের বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এই আঁশের জন্ম হয়। আঁশগুলো এককোষ বিশিষ্ট এবং দু’ধরনের- ছোটগুলো ঋধুু এবং বড়গুলো লিন্ট নামে পরিচিত। এই লিন্ট ও ফাজসহ বীজকে বীজতুলা বলে। এটিই ফসল হিসেবে গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়। বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনে ক্ষেতের উৎপাদিত বীজতুলাকে জিনিং করা হয়। (জিনিং-এর অর্থ বয়ন কাজে ব্যবহৃতব্য লিন্টকে বীজতুলা থেকে আলাদা করা)। সাধারণভাবে জাত ও মানের বিভিন্নতায় বীজতুলা হতে ৩০%-৪০% লিন্ট সংগৃহীত হয় এবং এই হারকে জিনিং শতাংশ বা বলে। তুলা উৎপাদন করার জন্য ব্যবহৃত (বপন করা) বীজকে তুলা বীজ বলে যাতে লিন্ট থাকে না, ফাজ থাকে।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/১০জানু২০২০