এলাচ দু রকমের বড় ও ছোট। বড় এলাচ এশিয়া, আফ্রিকা, অষ্টেলিয়া ও প্রশান্ত মহা-সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের শীত প্রধান অঞ্চলে প্রচুর জন্মায়। বড় এলাচের ৫০ প্রজাতির মধ্যে এই উপমহাদেশে বহু আগে থেকে বেশ কয়েকটি প্রজাতি ফলন হয়। সিলেট অঞ্চলে যে এলাচ জন্মায় তার নাম মোরঙ্গ এলাচ। আমাদের দেশে ঝোপ জঙ্গলে যে আদা গাছ জন্মায় বড় এলাচ গাছ দেখতে অনেকটা সে রকম। গাছে এলাচগুলো সাধারণত: গাছের গোড়ায় মাটি সংলগ্ন হয়ে গুচ্ছাকারে জন্মে। আষাঢ় মাসে ফুল হয় ও পরে ফল ধরে। ভাদ্র আশ্বিন মাসেন এলাচ পাকে। ফলগুলো দেখতে কালচে লাল হয়।
এলাচ একটি স্পর্শকাতর গাছ। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ছায়ার মধ্যে এই গাছ ভালো হয়। যেহেতু আমাদের দেশে বৃষ্টি কম, সে কারণে এখানে এলাচ গাছ বেড়ে উঠে না।
সাধারনত:রোদ্র-ছায়া যুক্ত জায়গায় এলাচ গাছ ও ফলন ভালো হয়। যেমন মেহগ্নি , লম্বু, আকাসমনি বা এ জাতীয় বাগানের ভিতর। ছোট এলাচ গাছ দেখতে আদা মত। তবে পাতাগুলো একটু বেশি লম্বা ও চওড়া। ভারতের বিভিন্ন স্থানে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে এই এলাচ প্রচুর জন্মে। তাছাড়া আদ্রতা যুক্ত পাহাড়িয়া জঙ্গল ও এই এলাচ চাষের উপযুক্ত।
এলাচের রং হলুদ ভাবাপন্ন হলে এই এলাচ সংগ্রহ করতে হয়। মশলা পাতির মধ্যে এই দুই ধরনের এলাচ অন্যতম। এই এলাচ শুধু মশলাই নয় এর ঔষধিগুণও কিন্তু অনেক। ওষুধ জগতে এলাচের খুব গুরুত্ব রয়েছে।
দেশের মাটিতে উন্নত জাতের এলাচ চাষঃ
বাংলাদেশের এলাচের চাহিদার শত ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করে মেটাতে হয়। মসলার জগতে এলাচ যেমন আবশ্যক তেমনি মূল্যবান। এটা ভেবেই দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা এলাচ আমাদের দেশে কেন ফলন হয় না এর উত্তর ছিল অজানা।
প্রতিবেশী দেশের মাটিতে উৎপাদন হলে আমাদের দেশের মাটিতে এলাচ কেন হবেনা? আমাদের দেশে এলাচের গাছ অনেক আগে থেকেই পাওয়া যেত । পূর্বে যে এলাচের গাছ প্রায় গ্রামেই লোকের বাড়ীর আঙ্গীনায় দেখা যেত সেগুলোতে 2-3 বছরের মাথায় ফুল আসত গাছের শাখায় কিন্তু কখনও ফল ধরতে দেখা যেত না যুগের পর যুগ পার হলেও।
আমার পিতামহের বাড়ীতেও ছিল এমন গাছ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি এলাচের গাছ কিন্তু কখনও ফল দেখতে পেতাম না। সেখান থেকে আমার শিক্ষা লাভের সূচনা হয় এবং একসময় জানতে পারি ফলন্ত এলাচ আর এই এলচের জেনেটিক জাত ই আলাদা। তার পর থেকে প্রচেষ্টা ভাল জেনেটিক জাত সংগ্রহ করা। আর এরই সূত্র ধরে আলাপ হয় জনাব শাহজাহান ভাই এর সাথে। তার সফল প্রচেষ্টায় আমরা আজ আমাদের প্রতিটি জাতের এলাচের গোড়ায় ফলন হয় বাছাই করে বিদেশ থেকে সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।
গাছ প্রতি ফলনঃ
রোপনের 2য় বৎসরে কিছু গাছে এলাচ ধরা শুরু করলেও রোপনের 3য় বৎসর থেকে এলাচের গাছে ফলন হয়। প্রায় প্রতি ঝোপে 800 থেকে 900 গ্রাম এমনকি 1 কেজি উপরে পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
বাজার মূল্যঃ
প্রতি কেজি এলাচের বর্তমান বাজার মূল্য 1300/- টাকা পাইকারী দরে এলাচ বিক্রয় যদি ধরা হয় 1000 টাকা তবে প্রতি বিঘায় উৎপাদান হয় সর্বনিম্ন 600 কেজি এবং সর্বোচ্চ 1000 কেজি। সেই হিসবে 1000×1000=10,00,000/- (দশ লক্ষ টাকা) প্রতি বিঘায়। পাঠক বন্ধু বলতে পারেন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমন কোন ফল বা ফসল আছে যা কিনা বিঘা প্রতি 10 লক্ষ টাকা আয় হবে। একমাত্র অর্থকরী ফসল এলাচ ছাড়া ?
জমি তৈরী ও চারা রোপন পদ্ধতিঃ
জমি তৈরী বড় আকারে করলে 1 বিঘা বা তার উপরে হলে অবশ্যই মাটির 3টি পরীক্ষা করে নিতে হবে । প্রতিটি জেলায় সরকারী মাটি পরীক্ষা কেন্দ্রে মাটি টেষ্ট করাতে পারেন। মাটি পরীক্ষা কৃষক পরর্যায়ে প্রতিটি পরীক্ষার জন্য 30/- টাকা ফি দিতে হয়। সেই হিসাবে 3 টি পরীক্ষা মোট 90/- টাকা খরচ হবে।(1) মাটির পিএইচ কত ? (2) মাটিতে বলি বা স্যান্ড এর পরিমাণ কত? (3) মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমান কত সেটাও জানতে হবে।
সবকিছু ঠিকঠাক পরিমাণ মত থাকলে এলাচ উৎপাদনে তেমন কোন খরচ হয় না অবশ্য 1ম বারের চারা কেনার খরচ ছাড়া পরের বছরগুলোতে। মাটিতে পিএইচ এর পরিমাণ 6 এর বেশী হলে মটির সাথে চুন মিশাতে হবে পরিমাণ মত। জমিতে বালির পরিমাণ কম থাকলে অতিরিক্ত বালি মেশাতে হবে যদি এটেল মাটি হয়।
দোয়াশ মাটিতে কোন কিছু করতে হয় না। মাটিতে জৈব উপদানের পরিমাণ কম থাকলে পচা গোবর সার বা কেঁচো কম্পষ্ট সার অতিরিক্ত প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও জমি তৈরীর সময় চাষের সঙ্গে টিএসপি, প্রতি শতকে মাটিতে 500 গ্রাম, পটাশ প্রতি শতকে 500 গ্রাম। জেঞ্জার বা ফুরাডান বা কার্বফুরান যা দানাদার কিটনাশক নামে পরিচিত (33 শতক জমিতে 2 কেজি পরিমাণ দিতে হবে।1দিন পর সেচ দিয়ে জমি ভাল ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। যাতে জমির সাথে সারগুলো ভালভাবে মিশে যেতে পারে।
ভাল ফলন পেতে হলে এর 2 সপ্তাহ পরে 2 ফিট চওড়া ও দেড়ফিট গভীর গর্ত করে গোবর সার বা জৈব সার প্রয়োগ করে সাথে দানাদার কিটনাশক অবশ্যই দিতে হবে প্রতি গর্তের গোবরের সাথে 200 গ্রাম। রোপনের পর জমিতে সেচ দিতে হবে। মনে রাখতে
হবে অতিরিক্ত পানি যেন গাছের গোড়ায় জমে না থাকে।
শতর্কতাঃ
জমিতে পানি জমে থাকতে দেয়া যাবে না। ঘন বর্ষায় চারা লাগানো যাবে না। চারা রোপনের পর পর গোল্ডাজিম লিকুইড স্কয়ার এর ছত্রাক নাশক পানির সাথে পরিমাণমত মিশিয়ে গাছের একেবারে গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।গোল্ডাজিম এলাচের গাছের জন্য ভাল কাজ করে। অতিরিক্ত পানি জমিতে লেগে থাকলে ড্রেনের ব্যবস্থা করে পানি নিস্কাশন করতে হবে।
জমি প্রতি চারা রোপনের হারঃ-
1 বিঘায় চারা রোপন করা যায় 460 টি । প্রতি শতকে লাগে 14টি চারা এবং 33 শতকে চারার পরিমাণ হলো 460 টি । 33 শতক জমি থেকে 3 বৎসর পরে ফলন হবে 900 থেকে 1000 কেজি বা 1 টন। অর্থাৎ 10 লক্ষ টাকার এলাচ বছরে উৎপাদন হবে।
পরিচর্যাঃ
রোপনের 3য় বৎসর পর শীতকালে ফলনের পর পুরাতন গাছ ছাটাই করতে হবে। অবাঞ্চিত মরা গাছ ছাটাই না করলে গাছে ভাল ফলন হয় না। শীতকালে এলাচ গাছে ফুল ও ফল হয়না বিধায় শীতকালে মরা গাছ ও দূর্বল গাছ ছাটাই করা জরুরী।
এলাচের ফলনের স্থানঃ
গাছের গোড়ায় মাটি সংলগ্ন হয়ে গুচ্ছ আকারে ফুল গজায় লতার মত। সেই ফুল গুলো থেকে ফল হয় গুচ্ছ আকারেই। বাংলাদেশে আমরাই একমাত্র এলাচ উৎপাদনকারী ও সম্প্রসারণকারী যাদের জাতগুলো সঠিক জাত ও আন্তর্জাতিক মানের চারা এবং যা প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে ফলন হয়।
বাংলায় আষাঢ় মাসে এই জাত গুলোর ফুল আসে এবং ভাদ্র ও আশ্বিন মাসের শেষের দিকে এলাচ পরিপক্ক হয়। তখন বাগান থেকে কাঁচা এলাচ সংগ্রহ করে রোদে শুকাতে হয় অথবা বেশী পরিমাণে উৎপাদন করলে ড্রায়ার মেশিনের সাহায্যে শুকাতে হয়। বর্ষায় হয় বলে এলাচ না শুকিয়ে ঘরে রাখলে পচন ধরবে। এলাচ ফল পরিপক্ক হলে ফলগুলো দেখতে কিছুটা সবুজের উপর লালচে হবে। এলাচের মান উন্নত করতে হলে আন্তর্জাতিক মার্কেটে স্থান করার জন্য কিছু নিয়ম পালন করতে হবে।
টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে ছোট ও বড় এলাচের চারা উৎপাদন
এলাচকে বলা হয় মসলার রাণী। সুগন্ধযুক্ত এই মসলাটির চাহিদা আমাদের দেশে প্রচুর। রান্নায় স্বাদ বাড়ানো ছাড়াও এর রয়েছে প্রচুর ঔষুধি গুন।কিন্তু কাংখিত এলাচের জাত আমাদের দেশে না থাকায় প্রতি বছর প্রায় দেড়শ কোটি টাকার এলাচ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়।
আমদানী নির্ভর এই মসলাটির সম্প্রতি আমাদের দেশে ব্যাক্তিগত উদ্যেগে খুব সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে চারা উৎপাদন ক্ষমতা অপ্রতুল হওয়ায় স্বল্প সময়ে কাংখিত জাতের বিস্তৃতি ঘটাতে টিস্যু কালচার একটি কার্যকরী সমাধান।
জায়গা/জমি শুকনা থাকলে চাষ / কুপিয়ে প্রতি কাঠায় ৫০০ গ্রাম হারে TSP ও POTASIUM সার ছড়ায়ে অথবা উক্ত সার মিশ্রনে ১ কেজি সার ৩০টা চারা পোতারগর্তে ছড়ায়ে ভিজায়ে দিতে হবে এবং মাটি শুকালে অথবা ৭দিন পর চারা রোপণ করা যাবে।শুকনা মাটিতে চারা রোপণ করলে বিকালে চারা রোপণের পরদিন সকালে ভিজাতে হবে। বীজ থেকে নয় মূল থেকেই জন্ম নেয় এলাচ গাছ।
কৃষিবিদ এস.এম ইসমাইল হোসেন
(কৃষি টিপস)
ফার্মসএন্ডফার্মার/০৪জুন২০