করোনাকালে বিপর্যয়ের মাঝে সুখবর নিয়ে এসেছে দেশের মৎস্য খাত। বিশ্বে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়েছে দেশে। স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। সম্প্রতি এটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির মাছ বাড়ার হারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। ইন্দোনেশিয়ায় ১২ শতাংশ আর বাংলাদেশে এ হার ৯ শতাংশ। বাংলাদেশে কৃতিত্ব ইলিশের আর দেশি মাছ চাষে। ইলিশ মাছের উৎপাদন বর্তমানে পাঁচ লাখ টনেরও বেশি। ইলিশে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বিশ্বে মোট ইলিশের প্রায় ৮৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। মৎস্য খাতে সম্ভাবনা আরও বাড়বে। বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় সমুদ্রসম্পদ।
এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বে প্রায় ১৮ কোটি টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এর অর্ধেকেরও বেশি স্বাদু পানির মাছ। বাকিটা সামুদ্রিক মাছ। ২০১৭ সালেই স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পঞ্চম থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে। এবারও সে অবস্থান ধরে রেখেছে। গত বছর প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে যথাক্রমে চীন ও ভারত। চাষের মাছে বাংলাদেশের অবস্থানটি চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের পরে।
এতে বলা হয়েছে, করোনায় অন্যান্য খাতে কর্মী ছাঁটাই হলেও মৎস্য খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বর্তমানে মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ জড়িত। আর পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণ। মাছ চাষ ও ব্যবসায় দুই কোটির কাছাকাছি মানুষ যুক্ত আছেন। ১৯৯০ সালে মানুষ মাথাপিছু বছরে সাড়ে সাত কেজি মাছ খেত। এখন সেটা ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে মানুষের মাছ খাওয়া বেড়েছে ১২২ শতাংশ। বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকের বেশি আসে মাছ থেকে। বাংলাদেশ প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। আর বিশ্বে গড়ে প্রাণিজ আমিষের ২০ শতাংশ আসে কেবল মাত্র মাছ থেকে। এদিকে গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় শতভাগ বেড়েছে। ২০১০ সালের সর্বশেষ খানা জরিপে উঠে এসেছে- বছরে বাংলাদেশে একেকজন মানুষ প্রায় ১২ কেজি মাছ খায়। এখন সেটা ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ যার এক-চতুর্থাংশ অবদান এককভাবে মৎস্য খাতের। আবার সার্বিক কৃষি খাতের গড় প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ হলেও মৎস্য খাতে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের উপরে রয়েছে।
মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্য সম্পদের অবদান এখন ৪ শতাংশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম যুগান্তরকে জানান, মৎস্য উৎপাদনে সব দিক দিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এ খাতে আরও এগিয়ে যাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে চাই।
ব্যাপক মাছ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। গবেষণা করে বিজ্ঞানীদের পরামর্শে সরকার ইলিশ রক্ষায় ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। গত চার বছরে উৎপাদন প্রায় দুই লাখ টন বেড়েছে। এ খাতকে কাজে লাগিয়ে বেকারত্ব দূর করাসহ কর্মসংস্থানে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা বিলুপ্তপ্রায় মাছের আধুনিক চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। সামনে আমরা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে গুরুত্ব দেব।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, দেশি মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে প্রথম। পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে দেশে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণ। আমরা নদী ও জলাশয়ে মাছের পরিমাণ এবং তার কতটুকু আহরণ করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা করছি। দেশের বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো পুকুরে চাষের বিষয়েও কাজ করছি। ইতোমধ্যে গ্রিনহাউস পদ্ধতি ব্যবহার করে গলদা চিংড়ি ও পাঙ্গাস মাছের আগাম ব্রড ও প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছি। আমাদের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত রুই, কাতলা, কই, তেলাপিয়া, কালবাউশ ও সরপুঁটির উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। তারা দেশের বিলুপ্তপ্রায় ২২টি প্রজাতির মাছের চাষপদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৯ডিসেম্বর২০২০