বকুল হাসান খাঁন
নিম গাছ আমরা সবাই চিনি। এটি হলো দেশী নিম, যা থেকে কীটনাশক তৈরি করা যায়। অন্য আরেক ধরনের নিম রয়েছে, যাকে বলে ঘোড়া নিম। দেশী নিমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঝুধফরৎধপযঃধ রহফরপধ ও মহানিম বা ঘোড়া নিমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম গবষরধ ধুধফরৎধপযঃধ। উভয় নিমই মেলিয়েসি পরিবারভুক্ত। নিম চিরসবুজ বৃক্ষ প্রকৃতির গাছ।
পাতা যৌগিক, পত্রফলকের কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা ও কাস্তের মতো বাঁকানো। পাতার আগা সুচাল। বর্ষার শুরুতে ফল পাকে। ফল ছোট, ডিম্বাকার, থোকায় ধরে। নিমের পতঙ্গবিনাশী গুণ থাকায় বর্তমানে এর বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি করা হচ্ছে নানা ধরনের কীটনাশক, যা উপকারী বিভিন্ন কীটপতঙ্গের জন্য কম ক্ষতিকর। নিম গাছের অংশেরই রয়েছে কম-বেশি পতঙ্গ দমনের ক্ষমতা। তবে বীজে তেল তথা কার্যকর উপাদান বেশি থাকায় বীজ পোকামাকড় দমনে অধিক কার্যকর। নিমের এ পতঙ্গবিনাশী প্রাকৃতিক গুণ দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক প্রজাতির বিভিন্ন ফসল নষ্টকারী কীটপতঙ্গ দমন করা সম্ভব বলে জানা গেছে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে নিম থেকে নানা রকম কীটনামক তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। এ দেশের বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে নিম্বিসিডিন।
নিম পাতার নির্যাস: এ নির্যাস তৈরি করতে হলে ৬ লিটার পরিমাণ পরিষ্কার পানিতে প্রথমে ৫ কেজি কাঁচা নিমপাতা ৫-৬ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভেজানো পাতা কুচিকুচি করে কেটে পিষে/বেটে মলমের মতো করতে হবে। তারপর তা পরিমাণ মতো পানিতে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে। ঠাণ্ডার পর পাতলা কাপড় বা ছাকনি দিয়ে ভালো করে ছেঁকে তার মধ্যে ১৫০ গ্রাম গুঁড়া সাবান/ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে মেশাতে হবে। এ পরিমাণ মিশ্রণ করে ৬০ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে ফসলের ক্ষেতে ছিটাতে বা ¯েপ্র করতে হবে। এটি ছোট লেদাপোকা দমনেও কার্যকর।
নিমপাতা গুঁড়া: এ ধরনের কীটনাশক তৈরি করতে হলে কাঁচা নিমপাতা ভালোভাবে পরিষ্কার করে ছায়ায় বিছিয়ে ২ সপ্তাহ শুকাতে হবে। এরপর শুকনা পাতা ভালো করে গুঁড়া করলেই সহজে এ ধরনের কীটনাশক তৈরি হবে। এটি দীর্র্ঘদিন ঘরে রেখেও ব্যবহার করা যায়। তবে এর সংরক্ষণ মেয়াদ বাড়াতে হলে সমপরিমাণ ধুতরাপাতা একই নিয়মে গুঁড়া করে মিশিয়ে রাখতে হবে। এ গুঁড়া বিভিন্ন ধরনের গুদামজাত শস্যের পোকা দমনে বেশ কার্যকর।
নিম বীজের গুঁড়া: এ জন্য কাঁচা নিম বীজ সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে খোসা ছাড়িয়ে ছায়ায় সপ্তাহখানেক শুকিয়ে নিতে হবে। শুকিয়ে গেলে তা ভেঙে শাঁস বের করে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে মিহি করতে হবে। এ গুঁড়া কাচের বয়ম বা বোতলে সংরক্ষণ করলে ভবিষ্যতেও ব্যবহার করা যায়।
নিম শাঁসের নির্যাস: তিন উপায়ে নিম বীজের শাঁস থেকে এ নির্যাস তৈরি করা যায়। ক. ১ কেজি নিম বীজ সংগ্রহ করে তা ধুয়ে পরিষ্কার করে কয়েকদিন (৭-১০দিন) ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর বীজের খোসা ভেঙে ভেতরের শাঁস বের করে তা পিষে মলমের মতো করতে হবে। এ মলম ৭৫ মিলিলিটার ডিটারজেন্ট/৭৫ গ্রাম গুঁড়া সাবানের সঙ্গে মিশিয়ে তাতে ১০০ লিটারপানি যোগ করতে হবে। ভালোভাবে মেশানোর পর সেভাবে এক রাত রেখে দিতে হবে। পরদিন সকালে ছেঁকে ¯েপ্র করতে হবে। এটি হবে ১% দ্রবণ। ঘনত্ব বাড়াতে হলে যেভাবে বীজ নিতে হবে। যেমন- ২% দ্রবণ তৈরি করতে হলে ২ কেজি বীজ নিতে হবে; কিন্তু পানির পরিমাণ থাকবে একই। খ. নিম বীজের শাঁস বেটে যে মলম পাওয়া যায় তার ১ কেজি ৫ লিটার পানি অথবা ৫ লিটার গো-মূত্রের সঙ্গে মিশিয়ে এক রাত রেখে দিতে হবে। পরে ৭০-৮০ ডিগ্রিসেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ২-৩ ঘন্টা ফুটিয়ে নামাতে হবে।
এ সময় দ্রবণের রঙ কালো হয়ে যাবে। তখন ঠাণ্ডা করতে হবে। পরে পাতলা কাপড় বা গামছা দিয়ে ছেঁকে কাচের বোতলে রেখে দিলে ভবিষ্যতে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের সময় ১% দ্রবণ তৈরি করতে হলে ৯৫ লিটার এবং ২% দ্রবণ করতে হলে ৪৭.৫ লিটার পানি মেশাতে হবে। এ দ্রবণ তখন সরাসরি জমিতে স্প্রে করার উপযোগী হয়। গ. নিম বীজের শাঁস বাটা মলম ১ কেজি কেরোসিন তেলে এক রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে তা ছেঁকে প্রয়োজনমতো পানি মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
নিমের তেল: কাঁচা নিম শাঁস বেটে/পিষে পাওয়া যায় নিম শাঁসের নির্যাস আর ভালোভাবে রোদে শুকনো বীজ বাদামের মতো ঘানিতে পিষে বের করা যায় নিমের তেল। এভাবে ৩ লিটার নিম তেল সরাসরি ২০০ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করার উপযোগী ১.৫% দ্রবণ তৈরি করা যায়। তবে পানির সঙ্গে তেলকে ভালোভাবে মেমানোর জন্য ২০০ মিলিলিটার তরল সাবান/শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে।
নিমের খৈল: বীজ থেকে তেল বের করার পর যা পাওয়া যায় তাই খৈল। এ খৈল চূর্ণ সরাসরি জমির মাটিতে ছিটিয়ে ব্যবহার করা যায়। নিম খৈলের জলীয় দ্রবণ: এ জন্য ১০ কেজি নিম খৈল ১০০ লিটার পানিতে এক রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে ছেঁকে নিয়ে তা ¯েপ্র করে ফসলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
যেসব বালাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়: অনেক ধরনের বালাই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নিমের আছে। ফসলের ক্ষতিকর অন্তত ১০০ প্রজাতির পোকামাকড় ও কৃমি নিম দমন করতে পারে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো- তুলার ফল ছিদ্রকারী পোকা, জাব পোকা, ধানের বাদামি গাছ ফড়িং, কপির সরুই পোকা, কপির লেদা পোকা, পঙ্গপাল, কাটুই পোকা, ধানের শীর্ষ কাটা লেদা পোকা, ফ্লি বিটিল, ধানের সবুজ পাতা ফড়িং, পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা, লাল মাকড়, ধানের মাজরা পোকা, সাদা মাছি, ধানের সাদা পিঠ গাছ ফড়িং, ধানের শুষড়ি পোকা, খাপড়া বিটিল ইত্যাদি। ঘোড়া নিম বা পাহাড়ি নিমের পোকা তাড়ানোর ক্ষমতাও বেশ। এ জন্য ১৫০ গ্রাম কাঁচা পাতা বেঁটে বা ৫০ গ্রাম শুকনো পাতা গুঁড়া করে ১ লিটার ঠাণ্ডা পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সে পানি ছেঁকে ¯েপ্র করলে ঘাস ফড়িংয়ের মতো পোকাও বিতাড়িত হয়। তবে নিমের কার্য ক্ষমতা বহুমুখী। নিম শুধু পোকাই তাড়ায় না, এর ক্রিয়ায় অনেক পোকার খাওয়া ও ডিম পাড়া, খোলস বদলানো ও বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেসব পোকা আর বংশ বাড়াতে পারে না। এতে ক্ষতি কমে যায়। এমনকি এর ছোঁয়ায় এসে অনেক পোকা নিস্তেজ হয়ে পড়ে বা মারা যায়।
ফার্মসএন্ডফার্মার/২৪ফেব্রু২০২০