এন্টিবায়োটিক প্রাণী কিংবা মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জটিল যে কোনো রোগে এন্টিবায়োটিক হয়ে ওঠে অপরিহার্য। কিন্তু ভয়ের বিষয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এন্টিবায়োটিক মানবশরীরে রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধী) হয়ে উঠছে। শরীরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠার কারণে যথাযথ কাজ করছে না চিকিৎসায়। চিকিৎসা বিধি না মেনে এন্টিবায়োটিক সেবন ঘটাচ্ছে এ বিপর্যয়। মৃত্যু হচ্ছে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মানুষের। পাশাপাশি খামারে পালিত প্রাণীর শরীরে এন্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং আমিষ হিসেবে সেসব প্রাণী খাওয়ায় মারাত্মকভাবে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণীদেহে মাত্রাতিরিক্ত বা নিয়ম-নীতি না মেনে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে পরিবেশের পাশাপাশি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে মানবশরীরে।
জানা যায়, এন্টিবায়োটিকযুক্ত পশুখাদ্য গরু, মুরগি বা মাছের শরীরে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি করে। খাবারের মাধ্যমে তা প্রবেশ করে মানবদেহে। এছাড়া এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী এই জীবাণু প্রাণী এবং পরিবেশে (যেমন- খামারে, পশুর বাজারে ও পরিবহনের সময়) ছড়িয়ে পড়তে পারে। যখন পশু জবাই করা হয় কিংবা খাবারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় তখন এই জীবাণু মাংস বা অন্যান্য প্রাণিজ পণ্যকে করতে পারে দূষিত। পশুর বর্জ্যও এন্টিমাইক্রোবিয়াল-প্রতিরোধী জীবাণু বহন করতে পারে। ফলমূল, শাকসবজি ও অন্যান্য পণ্য প্রাণীর অপরিশোধিত বা কম্পোস্টযুক্ত বর্জ্য মাটি বা পানির সংস্পর্শে দূষিত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কৃষি ও খাদ্যশিল্পে প্রাণী মোটাতাজাকরণ কিংবা রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিনিয়ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের অনেক দেশেই উৎপাদিত এন্টিবায়োটিকের প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় পশু উৎপাদনে।
বাংলাদেশ প্রাণিবিদ্যা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ব্রয়লার, লেয়ার, গরু, ছাগল ও ভেড়া থেকে প্রাপ্ত জীবাণুর প্রায় ৭১ শতাংশই একাধিক এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী।
প্রাণীদেহে এন্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর প্রভাব চিন্তা করে এরই মধ্যে অনেক দেশ মাংস উৎপাদনকারী প্রাণীদের জন্য এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়। ২০০৬ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রাণী মোটাতাজাকরণে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এসব দেশের ভোক্তাদের মধ্যে এন্টিবায়োটিকের নিয়মিত ব্যবহার ছাড়া উৎপাদিত মাংসের চাহিদা বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজির সভাপতি ডা. সানিয়া তাহমিনা জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ যে কারণে এন্টিবায়োটিক খায় প্রাণীদেরও সে ধরনের কারণেই এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিংবা না নিয়ে দেখা যায় জ্বর হলেই প্রাণীকে এন্টিবায়োটিক খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় রোগ যাতে না হয় সেজন্য আগে থেকেই এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। পশুর ওজন অনুযায়ী এন্টিবায়োটিকের মাত্রাও বাড়ে। মেশানো হয় মাছ-মুরগির খাবারের সঙ্গেও। ফলে এসব প্রাণীর মাংস, ডিম এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে ওঠে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নীতেশ দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, প্রাণীদেরও অসুস্থতা রয়েছে সেজন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু সেটা করতে হবে পরিমাণমতো ও চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী। নিজের মতো করে করা যাবে না। সব এন্টিবায়োটিক প্রাণীদেহে ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়। আবার অনেকগুলো নিষিদ্ধও রয়েছে।
‘ঔষধ প্রশাসন সম্প্রতি কিছু এন্টিবায়োটিক নিষিদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় এমন হয় যে বিপণনকর্মীরা খামারিদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে পরামর্শ দিচ্ছে। এ কারণে দেখা যায় প্রাণীদেহে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে। আর প্রাণীদেহে যদি সেই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায় তা খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে আসতে পারে। আর সেটি মানুষের জীবনযাত্রার চেইনের মধ্যে ঢুকে মানুষের ক্ষতি করছে।’
এ বিষয়ে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (ফাও) প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানী ও জাতীয় টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রাণীদেহে ভালো ও খারাপ দুই ধরনের জীবাণুই রয়েছে। জীবাণু খুব দ্রুত ছড়ায়। একটু সংস্পর্শে এলেই অন্য আরেকটি জীবাণুর মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। আর কোনো একজন মানুষের শরীরে যদি এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু প্রবেশ করে তা ভালো-খারাপ সব ধরনের জীবাণুর মধ্যেই এই প্রতিরোধী জ্ঞান পৌঁছে দেয়। এতে সেই শরীরে ওই এন্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। আমাদের দেশে যে পরিমাণে প্রাণীদের এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে এতে তাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের পাশাপাশি মলমূত্র থেকে পরিবেশে আর মাংস থেকে আমাদের শরীর এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।
হাবিবুর রহমান বলেন, এই ভয়াবহ অবস্থার কারণে ডব্লিউএইচও উদ্বেগ জানিয়ে নীতিমালা করে দিয়েছে কিছু এন্টিবায়োটিক সাধারণভাবে ব্যবহার বন্ধ করার জন্য। যাতে এই এন্টিবায়োটিক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ব্যবহার করা যায়। চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ৩০ ধরনের এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে একটি নীতিমালা গঠন করেছে জাতিসংঘ। এই নীতিমালার তিনটি ভাগ রয়েছে। যার মধ্যে ১১টি সাধারণভাবে দেওয়া যাবে, ৯টি রোগীর অসুস্থতা যাচাই-বাছাই করে দেওয়ার জন্য এবং ১০টি এন্টিবায়োটিক খুবই প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
সবচেয়ে ভয়াবহভাবে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় পোল্ট্রি ফার্মে জানিয়ে তিনি বলেন, গরু বা বড় পশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় যেটি অসুস্থ হয়েছে সেটিকেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পোল্ট্রিতে কয়েকটি মুরগি অসুস্থ হলে সব মুরগিকেই এন্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এতে তাদের শরীরে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেলে সেটি মানুষের খাওয়ার মাধ্যমেও রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে। অন্যদিকে মুরগির বর্জ্যের সঙ্গে যে জীবাণু বের হয় সেগুলো পানিতে, মাটিতে মিশে সেখানেও রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ফ্লেমিং ফান্ড ইউকে ও ইউ এসুএ আইডির অর্থায়নে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ এএমআর রেসপন্স অ্যালায়েন্স বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে নীতিমালা তৈরি করতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে মানুষ ও পোল্ট্রিতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা করে দিয়েছে। গরু ও মাছের জন্যও এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করা হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বেশ কিছু রোগের জীবাণুর ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এএমআর সার্ভিল্যান্স হালনাগাদ গবেষণায় মোট ২৭ হাজার ৪৩৮ জন রোগীর বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৮ শতাংশ জীবাণুর মধ্যে সব ধরনের এন্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা পাওয়া যায়। চলতি বছর পরীক্ষা করা ২৭৩টি নমুনার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যাকটেরিয়ায় এক ধরনের রাসায়নিক এনজাইম শনাক্ত হয়, যা ব্যাকটেরিয়া নিজে তৈরি করে এবং যা এন্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থেকে বাঁচতে করণীয়
১. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না।
২. চিকিৎসকদের ও যে কোনো সহজ অসুস্থতায় এন্টিবায়োটিক না দেওয়া।
৩. গবাদিপশু, পোল্ট্রি ও প্রাণীদের ভ্যাটেরিয়ান চিকিৎসকদের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার।
৪. ডব্লিউএইচও’র এন্টিবায়োটিক গাইডলাইন মেনে চলা।
৫ চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করা। সূত্র: জাগো নিজউজ
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২