ফুলনগরী ঝিনাইদহে কর্মসংস্থান হচ্ছে নারীদেরও

600

Jhenaidah-Pic-(1)

জাহিদুর রহমান তারেক, ঝিনাইদহ থেকে: ফুল ছাড়া কি প্রিয় মানুষকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছার কথা বলা যায়? হৃদয়ের মধ্যে জমে থাকা ভালোবাসা যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায় একটি ফুল ছাড়া। তাই ভালোবাসা দিবসে প্রিয় মানুষটিকে মূল্যবান কোনো উপহার দিতে পারুক আর নাই পারুক একটি ফুল দিয়ে প্রকাশ করতে পারে ভালোবাসার নতুন কথা।

১৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভালোবাসা দিবস। এ দিনে একটি ফুল অগণিত তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ সকল বয়সের মানুষের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঝিনাইদহের ফুলকন্যারা।

প্রতিবছর বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ভালোবাসা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। আর এই চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে ঝিনাইদহ এলাকার ফুল চাষিরা।

ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠের পর মাঠ চাষ করা হয়েছে গাঁদা, রজনীগন্ধ্যা, গোলাপ ও প্লাডিয়াসসহ নানা জাতের ফুল। এসব ফুল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ ও মালা গাথা থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত এলাকার অধিকাংশ মেয়েরা ফুলের কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে।

এ এলাকার উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন দূরপাল্লার পরিবহনে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। জাতীয় ও বিশেষ দিনগুলো ছাড়াও সারা বছর এ অঞ্চলের উৎপাদিত ফুল সারাদেশের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলনগরী বলে খ্যাত বালিয়াডাঙ্গার ফুলকন্যা আয়েশা বেগম ও জরিনা খাতুন জানান, আমরা বছরের বারো মাসই ফুল তোলা ও মালা গাথার কাজ করি। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিন সামনে রেখে কাজ একটু বেশি করতে হয়। আমাদের আয় উপার্জন ও বেশি হয়।

তারা আরো জানান, এখন সাসনে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে প্রতিদিন সকাল-বিকেল কাজ করতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ফুল নিতে ফুল ক্ষেত মালিকদের বাড়ি বসে থাকছে। ফলে সব কিছু রেখে সারাদিন ফুল তুলছি।

তারা জানান, প্রতি ঝোপা ফুল তুলে গেঁথে দিলে ফুল মালিক ১৫ টাকা করে দেয়। প্রতিদিন তারা ১৫ থেকে ২০ ঝোপা ফুল তুলতে পারে।

ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জ কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ঝিনাইদহ জেলায় প্রায় ৪শ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করা হয়েছে। গ্লাডিয়াস, রজনীগন্ধ্যা গোলাপ ও গাঁদাসহ নানা জাতের ফুল এখানে চাষ হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় কম, আবার লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা ক্রমান্বয়ে ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। জেলার গান্না, বালিয়াডাঙ্গা, তিল্লা, সিমলা, রোকনপুর, গোবরডাঙ্গা,পাতবিলা, পাইকপাড়া, তেলকুপ, গুটিয়ানী, কামালহাট, বিনোদপুর, দৌলতপুর, রাড়িপাড়া, মঙ্গলপৈতা, মনোহরপুর, সাইটবাড়িয়া, বেথুলী, রাখালগাছি, রঘুনাথপুরসহ ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ফুল চাষ করা হয়েছে ব্যাপক হারে। সবচেয়ে বেশি গাধা ফুল চাষ হয় কালীগঞ্জে বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়। এ কারণে সবাই এখন এই এলাকাকে ফুলনগরী বলেই চেনে।

সরেজমিনে ঘুরে বালিয়াডাঙ্গা বাজার, কোলাবাজার ও কালীগঞ্জের বাস টার্মিনালে দেখা যায়, দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন পরিবহনে নিয়ে আসছেন। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় লাল, সাদা আর হলুদ ফুলে।

সারাদেশের আড়তগুলোতে ফুল পাঠাতে আসা একাধিক ফুলচাষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সারা বছরই তারা ফুল বিক্রি করে থাকেন। তবে প্রতিবছর বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষের দিন, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবস প্রভৃতি দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এ সময় দামও অনেবটা বেশি হয়। ফুলচাষিরা নিজেরা না এসে সারা বছর তাদের ক্ষেতের ফুল চুক্তি মোতাবেক ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরের ফুলের আড়তে পাঠিয়ে দেন। এ সব স্থানের আড়তদাররা বিক্রির পর তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে ফুল চাষিদের টাকা খরচ করে ফুল বিক্রির জন্য কোথাও যেতে হয় না। তারা মোবাইল বা ফোনের মাধ্যমে বাজার দর ঠিকঠাক করে ফুল পাঠিয়ে থাকেন বলেও জানান কৃষকরা।

দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও দ্রুত পঁচনশীল এ ফসল সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো হিমাগার। ফলে যখন বাজারে যোগান বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ দাম কমে যায় তখন লোকসানে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না ফুলচাষীদের। ফলে কৃষকরা বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে।

বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক জানান, ১৯৯১ সালে এ এলাকায় সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন বালিয়াডাঙ্গার ছব্দুল শেখ। তিনি ওই বছর মাত্র ২০ শতক জমিতে ফুল চাষ করে স্থানীয় বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোতে ক্ষেত থেকেই বিক্রি করে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। এরপর থেকে এ চাষ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ধান, পাট সবজি প্রভৃতি ফসলের চাষ করে উৎপাদন ব্যয় বাদ দিলে খুব বেশি একটা লাভ থাকে না। কিন্তু ফুল চাষ করলে আবহাওয়া যদি অনুকুলে থাকে তাহলে যাবতীয় খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। ফলে দিন যত যাচ্ছে এ অঞ্চলে ফুল চাষ ততই বাড়ছে।

বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলকন্যা স্বরসতী জানান, আমরা বাড়ির সব কাজ শেষ করে মাঠে ফুল তুলতে যাই। ফুল তুলে বাড়িতে নিয়ে আসার পর ঝোপা তৈরি করি। এক ঝোপায় ১ হাজার গাধা ফুল থাকে। এক ঝোপা ফুল গেথে দিলে মালিক আমাদের ১০ টাকা দেয়। সারাদিনে আমরা ১০ থেকে ১৫টি ঝোপা তৈরি করি।সূত্র: এনবি

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন