বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও কৃষির জন্য করণীয় 

1225

061

দেখা গেছে , যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয় সে বছর রবি মৌসুমের (শীতকালীন) ফসলের ফলন ভালো হয় । এর কারণ হলো বন্যার মাএা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও খাদ্যোপাদান থাকে ।

তাছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয় সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেসন – গম , ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারে । ফলে ফলনের পরিমাণ হয় আশানুরুপ ।

অনেক বছর আগস্ট মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় না । এরূপ ক্ষেএে আমন ধান প্রকোপ দেখা দেয় না । এরূপ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন – বিইউ ধান-১ , ব্রিধান৫৬, বিনা ধান৭ এর চাষ করা যাবে । কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব । এজন্য ভাসমান পদ্ধতি বা দাপোগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা সম্ভব । তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায় , সেসব জমিতে ওই বছর নতুনভাবে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না । কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না । কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে , সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপন উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপন করা যেতে পারে ।

যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না । লক্ষ রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে । এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে ।

যদি বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরও স্থায়ী হয় তা হলে এসব জমিতে কোনোক্রমেই আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না । বরং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গরুর ঘাস হিসেবে মাসকলাই কিংবা পাতা জাতীয় স্বল্পমেয়াদি জাতের সবজি চাষ করা যেতে পারে । বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি অবশ্যই সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসের প্রথমেই রবি ফসল যেমন- গম, ভুট্টা, ডালজাতীয় ফসল ইত্যাদি চাষ করার জন্য প্রস্তত করতে হবে । অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায় । রোগবালায়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে । চর এলাকায় এবছর রবি ফসলের বাস্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না । কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম,ভুট্টা আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে । কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে । চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে । চরের কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ ।

অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গম চরে কাজ করতে আগ্রহী হয় না । ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে চরের কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে । এর মূল কারণ হলো অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থা ।মনে রাখতে হবে যে , চরের কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপওার জন্য তা হবে এক মারাতœক হুমকি । কারণ উঁচু ও ভালো কৃষি জমি প্রতি বছর প্রায় ০.৭০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে । চরকে এজন্যই বলা হয় ‘কৃষির হিডেন ডায়মন্ড’। কারণ প্রায় এক মিলিয়ন চরই হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের খাদ্যের আধার ।

যেহেতু চরে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে সেহেতু চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত । দেখা যায় দুর্গম চরে আধুনিক কৃষির তথ্যাদি অনেক বিলম্বে পৌঁছে । কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চর এলাকায় এখনও সোনালিকা জাতের গম চাষ করা হয় যা কৃষি বিজ্ঞানীরা বহু আগ থেকেই চাষ করার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন । অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বারি গম-২৬ কিংবা ২৮ এরই মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে চাষ হচ্ছে ।

চরের শস্য নির্ঝঞ্ছাটভাবে চাষ করা যায় । তবে উররাঞ্চল ও পদ্মার চরের মাটিতে বালুর পরিমান বেশি থাকায় মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয় । অন্যান্য এলাকার তুলনায় তাই চর এলাকায় বেশি সেচের প্রয়োজন হয় । আবার চরে বিদ্যুতের সুবিধা না থাকায় ডিজেলের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে হয় । এতে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায় ।

বন্যায় যেহেতু কৃষকের বীজ নষ্ট হয়ে যায় , সেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষক সংগঠন করে বীজ রক্ষণাগার তৈরি করতে হবে । বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষককে রবি ফসলের নির্বিঘ্ন চাষের জন্য বীজসহ কৃষি উপকরণ নিশ্চত করতে হবে ।

তাছাড়া বন্যার সময় গবাদিপশুর থাকার জন্য উঢ়ুঁ করে সরকারের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় গোয়ালঘর করা যেতে পারে । গবাদিপশুর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা না হলে চরের কৃষক উন্নত জাতের গবাদিপশু লালন পালনের জন্য উৎসাহিত হবে না । চরে কেইজ বা খাঁচা/প্যানকালচার পদ্ধতিতে বর্ষাকালে দ্রুতবর্ধনশীল মাছের চাষ করা সম্ভব বলে মাৎস্যবিজ্ঞানীরা মনে করেন । তবে সেজন্য কৃষককে প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে । চরে মাছের পোনা সহজে কৃষক পায় না । সেজন্য সম্মিলিভাবে চরের কৃষকদের সহযোগিতা করতে হবে । আগামী বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপওার জন্য চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।

সূত্র:কৃষি তথ্য সার্ভিস

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম