বাংলাদেশে শিং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ। এই মাছে ফ্যাট/তৈল এর পরিমাণ কম এবং প্রচুর পরিমাণে উচ্চমানের সহজপাচ্য আমিষ থাকায় সবার মধ্যে বিশেষ করে রোগীদের মধ্যে এ মাছের প্রচুর চাহিদা ও কদর রয়েছে। তাছাড়া শিংকে জিয়ল মাছ বলা হয়ে থাকে আর জিয়ল মাছের চাহিদা অন্য সব মাছের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি।
তাই রুই জাতীয় মাছের চেয়ে এদের বাজার মূল্যও অনেক বেশি। সাধারণত : মৎস্য চাষীরা আধানিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করেন, সেক্ষেত্রে তারা তুলনামুলক ভাবে বেশি মুনাফাও অর্জন করে থাকেন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, সহজেই শিং মাছের নিবিড় চাষ করা যায়। অন্য মাছের তুলনায় শিং মাছের নিবিড় চাষ অধিক লাভজনক। ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেক চাষী বিএফআরআই এর কারিগরি সহযোগীতায় শিং মাছের নিবিড় চাষ করে অধিক লাভবান হয়েছেন। এ প্রবন্ধে শিং মাছের নিবিড় চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
শিং মাছের নিবিড় চাষ পদ্ধতিঃ
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতিঃ
শিং মাছের নিবিড় চাষের জন্য ২০-৫০ শতাংশ আয়তনের ছায়াযুক্ত পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৭-৮ মাস ১.৫০ থেকে ২.০ মিটার পানি থাকে
শিং মাছ নিবিড় চাষের জন্য প্রথমত পুকুর ভালভাবে শুকাতে হবে। শুকানোর পর তলদেশের পঁচা কাদা অপসারণ করতে হবে এবং পাড় ভালভাবে মেরামত ও মজবুত করতে হবে
অতপর তলদেশ ছয় থেকে সাত দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। পরবর্তীতে তলা থেকে ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করার লক্ষ্যে প্রতি শতাংশে ২০-৩০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে
ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পরে পুকুর বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ১.৫ মিটার পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে
পানি পূর্ণ করার পর শতাংশ প্রতি ০.৫-১.০ কেজি কলিচুন পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করে পুকরে প্রয়োগ করতে হবে
চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে পোনা মজুদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোনা পরিবহনঃ
গুণগত মানসম্পন্ন সুস্থ-সবল পোনা সংগ্রহ এবং পরিবহন শিং মাছ চাষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত, শিং মাছের পোনা হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করা হয়। সে ক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন সুস্থ-সবল বড় আকারের পোনা সংগ্রহ করতে হবে।
শিং মাছের পোনা পরিবহনকালে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, সে কারণে পোনা পরিবহনের সময় প্লাস্টিক ড্রাম ব্যবহার করাই উত্তম। দূরত্ব অনুযায়ী প্রতি ড্রামে ৭-৯ সেমি আকারের ৩-৪ কেজি পোনা অথবা ১০০০-১৫০০ টি পোনা পরিবহন করা যায়। এরুপভাবে ৫-৬ ঘণ্টা সময় দূরত্বে নির্বিঘ্নে পোনা পরিবহণ করা যেতে পারে।
পোনা মজুদঃ
শিং মাছের নিবিড় চাষ ব্যবস্থাপনায় প্রতি শতাংশে ৩-৪ গ্রাম ওজনের ৩৫০০-৪০০০টি সুস্থ-সবল ও গুণগতমানসম্পন্ন স্ত্রী পোনা প্রস্তুতকৃত পুকুরে মজুদ করা যেতে পারে। পুকরে পোনা মজুদকালীন সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পোনা পুকুরে মজুদের সময় অবশ্যই পোনা ভর্তি পাত্রের পানির তাপমাত্রা ও পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমতায় এনে ভালভাবে অভ্যস্থকরণ বা কন্ডিশানিং করতে হবে। সাধারণত কম তাপমাত্রায় সকালে বা সন্ধ্যায় পোনা মজুদ করাই উত্তম।
সম্পূরক খাদ্যঃ
পোনা মজুদের পরের দিন থেকে প্রাণিজ প্রোটিন (৩২-৩৫%) সমৃদ্ধ সম্পূরক খাদ্য মাছের দেহ ওজনের শতকরা ১২-৩% হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে
সম্পূরক খাদ্য দুই ভাগ করে সন্ধ্যায় ও সূর্য্য উদিত হওয়ার পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়।
প্রতি ১০ দিন অন্তর মাছের নমুনায়ণ করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ ও সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
পানির গুণাগুণঃ
শিং মাছ চাষের জন্য পানির গুণাগুন উপযোগী মাত্রায় থাকা বাঞ্চনীয়। এ জন্য নিয়মিতভাবে পানির গুণাগুন পরীক্ষা করা আবশ্যক। অধিক উৎপাদন পেতে হলে পানির গুণাগুন উপযোগী মাত্রায় রাখার জন্য নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
নিয়মিতভাবে পুকুরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
পানির গভীরতা ৫-৬ ফুটের মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে।
পানির pH সবসময় ৭.০ – ৮.০ এর মধ্যে রাখা আবশ্যক।
পানির স্বচ্ছতা ৩০ সে:মি: এর ওপরে থাকতে হবে।
অ্যামোনিয়ার মাত্রা ০.১ এর নিচে অবশ্যই রাখতে হবে।
মজুদত্তোর ব্যবস্থাপনাঃ
প্রতি ১০ দিন অন্তর শিং মাছের নমুনায়ণ করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
পোনা মজুদের এক মাস পর হতে প্রতি ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ১০০ গ্রাম চুন ও পরবর্তী ১৫ দিন পর ৪০০ গ্রাম লবন প্রয়োগ করতে হবে।
সপ্তাহে কমপক্ষে ০৩ দিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
পুকুরের আয়তন অনুসারে এক বা একাধিক স্থানে কচুরি পানার বেষ্টনী স্থাপন করতে হবে।
পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে গেলে অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে।
ক্ষতিকর প্রাণির প্রবেশরোধে পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে বেষ্টনী দিতে হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাঃ
শিং মাছ চাষকালীন সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়াবলী অনুসরণ করতে হবে-
শিং চাষে জৈব নিরাপত্তা ও রোগ প্রতিরোধ কৌশলঃ
পুকুরের অভ্যন্তরীণ জীবাণু ধ্বংস করা প্রয়োজন। জীবাণু ধ্বংস করার জন্য পুকুর শুকানো, চুন প্রয়োগ এবং পরিবেশবান্ধব জীবাণূনাশক ব্যবহার করতে হবে
পুকুরে বহিরাগত জীবাণু প্রবেশ রোধ করার লক্ষ্যে পুকুরের পাড় শক্ত ও মজবুত করার পাশাপাশি পুকুরের চারপাশে নেটের বেড়া দেওয়া, বহিরাগত প্রাণীর প্রবেশ রোধ, জালসহ বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহারের পূর্বে শুকানো এবং জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
খামারের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে পুকুর প্রস্তুতি থেকে মাছ ধরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উন্নত ব্যবস্থাপনা, সুস্থ ও সবল পোনা নির্বাচন, সঠিক ঘনত্বে পোনা মজুদ এবং নিয়মিতভাবে পরিমিত সুষম খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে
খামারে মজুদকৃত মাছের স্বাস্থ্য নিয়মিতভাবে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
শিং মাছের রোগবালাই ও প্রতিকারঃ
খামারে চাষকালীন সময়ে শিং মাছ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীজনিত রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। নিম্নে এ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারের বিষয়ে উল্লেখ করা হলো:
শিং মাছের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগঃ
সাধারণত, শিং মাছ Aeromonas sp. I Pseudomonas sp. ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। নিম্নে রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারের বিষয়ে আলোকপাত করা হলো-
রোগের লক্ষণসমূহঃ
আক্রান্ত মাছ খাদ্য গ্রহণে অনীহা প্রদর্শন করে।
মাছের শরীরে সাদা দাগ দেখা যায়।
মাছের লেজে পঁচন দেখা যায়।
সাদাটে দাগ ক্রমশঃ বিস্তৃত হয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে ঘা দেখা যায়।
মাছের শরীরে শ্লেষ্মার পরিমাণ কমে যায়।
মাছ ভারসাম্যহীনভাবে মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দিয়ে চলাফেরা করে।
প্রতিকার বা নিয়ন্ত্রণঃ
পানি পরিবর্তন ও সঠিক ঘনত্বে শিং মাছ চাষ করতে হবে।
শতাংশ প্রতি ২০০ গ্রাম হারে চুন ও ৪০০ গ্রাম হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে।
শতাংশে প্রতি ৩ ফুট গভীরতার জন্য ৫-৭ গ্রাম হারে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ৩-৪ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
প্রতি কেজি খাবারের সাথে ১-২ গ্রাম সিপ্রোফ্লোক্সাসিন মিশিয়ে ৫-৭ দিন খাওয়াতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদনঃ
সাধারনত, পোনা মজুদের সাত মাস পর মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময়ে মাছের গড় ওজন ৫৫-৬৫ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পুকুর শুকিয়ে শিং মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে
এ পদ্ধতিতে অনুসরণে পঞ্চাশ শতাংশের পুকুর হতে ০৭ মাসে ৮.০-৯.০ টন শিং মাছ উৎপাদন করা যায়
শিং মাছের নিবিড় চাষে ৫০ শতাংশ পুকুরে ৩.৫-৪.০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এক ফসলে ০৮-০৯ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
বিশেষ পরামর্শঃ
সফলভাবে শিং মাছের নিবিড় চাষ করার নিমিত্ত নিম্নের বিষয়গুলো বিশেষভাবে অনুসরণ করতে হবে-
সুস্থ ও সবল (৩-৪ গ্রাম) এবং একই আকারের শিং মাছের স্ত্রী পোনা মজুদ করতে হবে।
জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।
সপ্তাহে একদিন খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
নিয়মিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
বেড় জাল টেনে মাছের নমুনায়ন না করাই উত্তম।
উন্নতমানের ৩২-৩৫% প্রোটিনসমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়মিত পানির গুণাগুন পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং পানির পিএইচ সবসময় ক্ষারীয় মাত্রায় রাখতে হবে।
পুকুরের গভীরতা তুলনামূলক বেশি থাকতে হবে।
সর্বদা পুকুরের পরিচর্যা বা যত্ন নেওয়া অপরিহার্য।
ফার্মসএন্ডফার্মার/৩ফেব্রু২০২০