বিলুপ্তির পথে কুয়াকাটার ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি

89

 

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে রয়েছে বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের অন্যতম পল্লি। কিন্তু এখন সেখানে আর চোখে পড়ে না সারি সারি মাছের স্তূপ আর শত শত মানুষের কর্মব্যস্ততা। অথচ একসময় সৈকতের বালিয়াড়িতে অর্ধশত ঘর নিয়ে গড়ে ওঠা শুঁটকি পল্লি হয়ে থাকত জমজমাট। ছিল মাছ শুকানোর উৎসব। কিন্তু দিন দিন এই পেশা এবং ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে কুয়াকাটা সৈকতের শুঁটকি পল্লিতে মাত্র তিনটি শুঁটকির আড়ত আছে। যেখানে আজ থেকে ১৫ বছর আগেও ৫০টির ওপরে শুঁটকি আড়ত ছিল।

জেলার তিনটি বড় মৎস্য বন্দর রয়েছে কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুর ও কুয়াকাটায়। এ বাজারগুলো থেকে মাছ সংগ্রহ করে কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লিগুলোতে নিয়ে যান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মহিপুর, আলিপুর, লেবুর চর, গঙ্গামতির চর, গোড়াখালসহ বিভিন্ন চরে মাছের শুঁটকি উৎপাদনে এ সময় ব্যস্ত থাকেন ব্যবসায়ীরা। লইট্টা, ফাইসা, ছুরি, ছোট চিংড়ি, ছোট পোয়া, রইসা, রূপচাঁদা, লাক্ষাসহ প্রায় ৩৫ জাতের মাছ শুঁটকি করা হয় এসব পল্লিতে। তবে আগের তুলনায় যা এখন শূন্যের কোঠায়।

প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে প্রায় সাড়ে চার মাস চলে শুঁটকির ব্যবসা। কেমিক্যালমুক্ত ও পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে শুঁটকি তৈরি করায় এখানকার শুঁটকির চাহিদাও অনেক। প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয় কুয়াকাটা থেকে। তবে সরকারি সহযোগিতা এবং ১২ মাস শুটকি উৎপাদন করতে পারলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে এই বিষমুক্ত শুঁটকি। এমনটাই বলছেন ব্যবসায়ীরা।

কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লির ব্যবসায়ী ও তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা যে শুঁটকি উৎপাদন করি তাতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। শুধু লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রোদের আলো ও বাতাসের সাহায্যে শুঁটকি তৈরি করি। কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটকরা এখান থেকে তাদের পছন্দমতো শুঁটকি সংগ্রহ করেন এবং বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুয়াকাটার শুঁটকি পৌঁছে দিই আমরা। তবে এ বছর ব্যবসার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। নভেম্বর মাসের বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় ৮-১০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। আমরা সরকারের একটু সহযোগিতা পেলে আরও ভালোভাবে শুঁটকি তৈরি করতে পারব।

এই পল্লির অপর এক ব্যবসায়ী বশির আহমেদ বলেন, আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ কেমিকেল ছাড়া শুঁটকি তৈরি করছি। বছরের শুরুতেই কাজের চাপ একটু বেশি। কারণ কিছুদিন আগে আবহাওয়া খারাপ থাকায় সময়মতো শুঁটকি উৎপাদন শুরু করতে পারিনি। আমাদের স্থায়ী কোনো জায়গা না থাকায় প্রতিবছর বিভিন্ন জায়গা পরিবর্তন করা লাগে, যা আমাদের জন্য কষ্টের বিষয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ। আমাদের যদি সরকার একটা স্থায়ী জায়গা ঠিক করে দিত তাহলে আরও ভালোভাবে শুঁটকি তৈরি করতে পারতাম। তবে এ বছর বিক্রি খুবই কম কারণ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তেমন কোনো পর্যটক কুয়াকাটায় আসছে না। সেজন্য চাহিদা অনুযায়ী বিক্রিও নেই আমাদের।

তিনি আরও বলেন, এখানকার উৎপাদিত শুঁটকির সিংহভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, জামালপুর, গাইবান্ধা, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রংপুর, সিলেট, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। স্থায়ী জায়গা ও সরকারের সহযোগিতা পেলে এই শিল্পটিও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কুয়াকাটায় পরিবার নিয়ে খুলনা থেকে বেড়াতে আসা এক পর্যটক বলেন, আমি আমার পরিবারের চার সদস্য নিয়ে কুয়াকাটায় এসেছি। কুয়াকাটা খুবই সুন্দর একটি জায়গা বেড়ানোর জন্য। আমি এর আগেও একাধিকবার এখানে এসেছি। কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লি আমাদের খুবই পছন্দের একটি জায়গা, এখানে খুব সুন্দর পরিবেশে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। আমার দুই মেয়ে ও স্ত্রী শুঁটকি তৈরি করা দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত। তবে আগের চেয়ে শুটকি তৈরির ব্যস্ততা অনেকটা কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, কুয়াকাটায় উৎপাদিত শুঁটকির বেশ সুনাম রয়েছে। এখানে যারা শুঁটকি তৈরি করে তারা বেশ অভিজ্ঞ। গত দু’বছরে কুয়াকাটাসহ কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন পল্লিতে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে। শুঁটকি ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়ার বিষয়ে সরকারের একটি পরিকল্পনা আছে এবং আমরা তাদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি। বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের চেষ্টা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কুয়াকাটায় মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সবকিছু পরিকল্পিতভাবে করা হবে। সরকার কুয়াকাটাকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়। শুঁটকি যারা প্রস্তুত করেন ও যারা বিক্রি করেন, সবাইকে এক ছাতার নিচে আনা হবে এবং শুঁটকি পল্লিগুলোকে একটি স্থায়ী জায়গায় নেয়ার পরিকল্পনা চলছে।